লোকান্তিকা মর্মধ্বনি : বঙ্গনারীর অন্তর-বাহির

আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

কল্যাণী অনামিকা


বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সত্তরের মাঝামাঝি হতে সক্রিয় কবি অনীক মাহমুদ (জন্ম ১৯৫৮)। আর তা আজ অবধি সমভাবে চলমান। তাঁর বহুবিধ মানস-চিন্তার প্রতিবিম্ব শতাধিক গ্রন্থ। কাব্যজগতে প্রেমের দৌর্দাণ্ডপ্রতাপ ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেম বড় স্বৈরতন্ত্রী’। পত্রকাব্য, গীতিকাব্য, রুবাই এসব রচনার পাশাপাশি কবি বাংলার লোককথা অঙ্গনে বিচরণ করেন। লিখেন ‘লোকান্তিকা মর্মধ্বনি’। বাংলার লোকনারী-গাথা বিনির্মাণে তাঁর কাব্যমুন্সিয়ানার এক অভিনব দিক।

প্রতিনিয়ত নিজেকে নির্মিতির ধারাজলে ডুবিয়ে যে চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুললেন তা তাঁর কাব্যপাঠ মাত্রই অনুধাবন করা যায়। এ শুধু লোকজ জীবনাষঙ্গ নয় বরং যাপিত জীবনে জড়িয়ে থাকা নারীত্বের জীবনাচার,

লোকজ ফর্ম, স্বয়ং নিজেকে ভেঙেচুরে বার বার নির্মাণ করার যে প্রবণতা তা এ লেখায় নক্ষত্রসমান প্রতিয়মান। ডিসেম্বর ’২২-এ প্রকাশিত ‘লোকান্তিকা মর্মধ্বনি’ কাব্যটিতে স্থান পেয়েছে মোট ২৯টি কবিতা। ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, রূপকথা, প্রচলিত যাত্রাপালা এমনকি বাংলা উপন্যাস-ছোটগল্পে যেসব নারীচরিত্র কালের যাত্রায় হারিয়ে না গিয়ে লোকজ জীবনের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেসব নারীরা এই কাব্যের চরিত্র। এই কাব্যের প্রাণভূমির কেন্দ্রে তারাই আছে। ২৯টি কবিতার মধ্যে ময়মনসিংহগীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকার পাতা থেকে ১০টি নারীচরিত্র নিয়ে লেখা ১০টি কবিতা কাব্যের বিস্তৃত অংশ জুড়ে আছে। কবিতাগুলো হলো: ‘মহুয়া’ ‘মলুয়া’ ‘মদিনাসুন্দরী’ ‘কাজলরেখা’ ‘কমলা’ ‘সুনাই’, ‘রূপবতী’ ‘লীলাবতী’‘পালংসই এবং ‘মধুমালা’।

রূপকথা ঠাকুরমার ঝুলি এবং ঠাকুরদাদার ঝুলি অবলম্বনে ‘জরিনা সুন্দরী’ ‘কাঞ্চনমালা’ ‘কঙ্কাবতী’ ‘রূপবান’-এই চারটি কবিতা রচিত। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের বেহুলা চরিত্র অবলম্বনে ‘বেহুলা’ ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘কালকেতু উপাখ্যান’-এর ফুল্লরা চরিত্র অবলম্বনে ‘ফুল্লরা’ আক্ষেটিক খণ্ড হতে রচনা করেন ‘খুল্লনা ও লহনা’ ধর্মমঙ্গল কাব্য অনুসরণে ‘লখাই’ এই চারটি কবিতার অবয়ব নির্মিত। নাথসাহিত্যের ময়নামতী চরিত্রকে ঘিরে সৃষ্ট কবিতা ‘ময়নামতী’। এমনকি বৈষ্ণব পদাবলীর চণ্ডীদাস ও রামী রজকিনীর প্রেমোপাখ্যান ও দৃষ্টি এড়ায়নি কবির। রচনা করেছেন ‘রামী রজকিনী’ কবিতা। জসীম উদ্দীনের পল্লি-বাংলার জীবন ও প্রেম ঘিরে রচিত ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘দুলী’ কবিতা এবং ‘নকশী কাঁথার মাঠ, ‘সাজু’ কবিতার পঙ্ক্তি এবং ‘আসমানী’ কবিতার চরিত্র হতে ‘আসমানী’ নারীর গড়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘শাস্তি’ কবি অনীক মাহমুদের ‘চন্দরা’ কবিতার মূলভূমি। বাংলা উপন্যাস হতে পাঁচটি নারীচরিত্র গ্রহণে রচনা করেন পাঁচটি কবিতা।

যেমন: ‘জৈগুন’ ‘হুরমতি’ ‘সর্বজয়া’ ‘নবীতুন’ ও ‘আসেকজান”। চরিত্রগুলো যথাক্রমে আবু ইসহাক রচিত ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’, শহীদুল্লা কায়সার রচিত ‘সংশপ্তক’, ‘সারেং বৌ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ এবং শওকত ওসমানের ‘জননী’ উপন্যাস হতে গ্রহণ করা হয়েছে। তিরিশি কবি জীবনানন্দ দাশও বাংলার লোকজ নারীদের চাল ধোয়া হাত আর বিনুনি খসানো অবয়ব নির্মাণ করেছেন ‘রূপসী বাংলা’য়। রূপকথার ধূসর জগতে থেকে শঙ্খমালা, মানিকমালাদের রূপ অবলোকন করেন। তাদের চাল ধোয়ার ধূসর হাতের গন্ধ অতীত ইতিহাসে ডুব দিতে সহায়তা করে।

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় রূপকথার নারীকে ঘিরে রচনা করেন ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাস। কবি অনীক মাহমুদ কী তাদেরই পথ অনুসরণ করেছেন এই কাব্যগড়ানায়? তাঁর লোকনায়িকারা কী শুধু লোকজীবনেরই কথা বলে? লোককথার নারীদের ঘিরে যে নারীত্বের শরীরী অবয়ব নির্মাণ করেছেন তা যে শুধুই লোকনারীর নয় একথা কাব্যের অন্তর্বয়ান নির্দিষ্ট করে দেখায়। জীবনানন্দের মতো লোকনারীদের তিনি গ্রহণ করেছেন সত্য কিন্তু কেবলই রূপসী বাংলা চালচিত্র ও ঐতিহ্য ধারণ বা ইতিহাসের পাতায় পদচারণই এর মুখ্য বিষয় নয়। বাহ্যিক আবরণে এই লোকান্তিকা নায়িকারা বঙ্গনারীর শাশ্বত রূপাবয়ব বহন করেই অন্তর্জগতে ধারণ করে আছে আধুনিক নারীর শক্তি, দার্ঢ্য, নারীত্বের অহংকার আর আত্মমর্যাদার কথাবৃত্ত।

অন্যদিকে ত্রৈলোক্যনাথের অতিলৌকিক মায়াময় পরিবৃদ্ধির জগতও এখানে অনুপস্থিত। যা কিছু এই কাব্যে উপস্থিত তা হলো নারীত্বেরই শক্তির বলয়ে সৃষ্ট জগৎ। রূপকথায় নায়িকা লোকান্তিকার স্বপ্ন নিয়ে ঘরকন্যায় সঙ্গে নিশে থাকে সত্য কিন্তু বাস্তবতার নির্মমতায় যে অধ্যায় নির্মিত হয় সেখানে কঙ্কাবতীদের সংগ্রামও বাস্তব পরিবৃত্তে জড়ানো। অনাহুত দৈবের সংযোগে প্রেম ও নারীত্বের বিফল মনোরথ কাব্যের মহুয়া মলুয়াদের প্রেমার্তির দাগ রেখে যায়। সেখানেই আত্মমর্যাদায় স্থির নারী মদিনাসুন্দরীর বিরহে পুরুষশাসিত সমাজের পক্ষপাতদুষ্ট বিচার আর ভুলের খেসারত নারীর অহংচেতনার দার্ঢ্য ঘোষণা করে। প্রেমবঞ্চিত নারী মদিনার অধিকার বঞ্চনার দায়ভারে অবশেষে পৌরুষের সন্ন্যাস ধারণের দৃশ্য চোখে পড়ে।

কবির ভাষ্য:
দেওয়ানা দুলাল ভুলের মাহূর্তিক খেসারতে/ প্রাণের ডেগুমা হয়ে সন্ন্যাসীর নিমীলিত ক্ষতে,
বান্যাচঙ্গ বাংলার আকাশে বাতাসে ঘসির আগুন/ কেবল জ্বালিয়ে করে বিরহ তর্পণ মহা শোকানলব্রতে!
(মদিনাসুন্দরী, পৃ. ১২)
স্বামীর প্রাণ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় স্থিরপ্রতিভা নারী বেহুলা, দাসীত্বের বোঝা, পিতার পরিত্যাক্ত নারী কাজলরেখা,
পিতৃকর্মচারী কারবুন ও গোয়ালিনীর ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে কমলা সুন্দরীরা নারীত্বের জয়ধ্বজা বহন করে চলে। পৃথিবীতে শকুনিয়া হিংস্র নখরে বিধ্বস্ত করতে চায় নারীত্বের সম্ভ্রম। এইসব শকুনিদের বিরুদ্ধে আদর্শিক অগ্নির বহর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুনাইয়ের ত্যাগ, রূপবতীর স্বামীর প্রতি নিষ্ঠা, কঙ্কাবতীর অমিয় সাধনার কথার ছলে। আদর্শিক এই ধারা মঙ্গলকাব্যের ফুল্লরা, খুল্লনা-লহনা, লখাই কিংবা নাথ সাহিত্যের ময়নামতীর অধ্যায় পেরিয়ে বর্তমানেও প্রবাহিত। ষোড়শী কন্যারূপী চণ্ডীদেবীকে দেখে তাই ফুল্লরার ক্ষোভঝরা উক্তি কিংবা মার মাসীর বর্ণনা, খুল্লনা-লহনার সপত্নী বিদ্বেষ নারীচরিত্রের মানস পরিবৃদ্ধির তরফে উন্মোচিত করে। পল্লিকবির সাজু-দুলী-আসমানীয়া প্রেম সংগ্রাম ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচে। কবি অনীক মাহমুদ সাজুর প্রেম-বিরহ সন্তাপে মৃত্যুতে জীবনেরই অন্যরকম পাঠ রচনা করে দেখান।

দুলীকে ঘিরে জাত-পাত আর সংস্কারের বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষাকারী নারীর চরিত্র আঁকেন। বলেন:
জাতিত্বের বাধা সমাজের ম্রিয় সাধা,
ম্লান অবসাদে গিয়েছিলো উড়ে
উৎসর্গের পারিজাত চুঁয়ে। (দুলী, পৃ. ২৩)
অসবর্ণ সংস্কার, জাতি-সমাজের বাধায় আজও বহু প্রেমযুগলবন্দী প্রাণ ভেসে যায় কালের গহ্বরে।

প্রেমের সামিয়ানা সেখানে আর ¯’ায়ী কোন নীড় বাঁধতে পারে না। দুলী-সোজনের বিসর্জন আর আত্মবোধকে তাই কাব্যে আমাদের নিত্যদিনের বেহাগ তালের সঙ্গে বাধা হয়েছে সযত্নে। আসমানীদের দারিদ্র আর সংগ্রাম শুধু আজ লোকমুখেই প্রচারিত নয়। তার পড়নের শতছিন্ন বসন, পেটের পীড়া, বুকের কঙ্কাল, অনাহারের চিহ্ন ভেন্নাপাতায় ছাওয়া ঘর অবশেষে সমাজ সেবক আর শান্তি নিবাসীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় দারিদ্র্যের চিহ্ন। অবশেষে চিরশান্তিধামে তার বিদায়ের কথকতায় কবি অভিজাত চাকচিক্যময় সমাজের প্রতি ছুড়ে দেন শ্লেষের ঝংকার। বাংলা উপন্যাসের পটে জৈগুন, হুরমতী, নবীতুন, সর্বজয়া আর আসেকজানেরা দারিদ্র্য, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, নারীত্বের প্রতিষ্ঠায় অবিচল নারীচরিত্র। কবি জৈগুনের সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বিশিষ্ট করে তুলেছেন যার বলে দাসীবৃত্তি ত্যাগ করে চাল ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

একা সংসারের ঘানিটানা নারীর মানসিক শক্তির কাছে হার মানে উ” ছদের ষড়যন্ত্র, হার মানে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা। গদু প্রধানের মতো লোকেদের লালসাবৃত্তিকে পায়ে মাড়িয়ে জৈগুনের টিকে থাকা। আর টিকে থাকা স্বামী করিম বকসের অত্যাচার উপেক্ষা করে। মন্বন্তরের ঘটায় যখন সমগ্র বাংলাও বিধ্বস্ত তখনও
তার অস্তিত্বের সংগ্রাম, সংসার বাঁচিয়ে রাখার লড়াই নারীশক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘সংশপ্তকে’র হুরমতীকে কাব্যে দেখা যায় প্রতিবাদী নারীসত্তার প্রতীকরূপে। ব্যভিচারিণী হিসেবে সমাজ তার কপালে ছাঁকার দাগ এঁকে দেয়। লোকান্তিকা মর্মধ্বনি কেবল লোকনায়িকাদেরই বয়ান নয় বরং শাশ্বত বাঙালি নারীর আদ্যোপান্ত বিনির্মাণ করে। লোকজীবনের পটচিত্র হতে বেরিয়ে তারা বঙ্গনারীর অন্তর বাহির

নিয়ে উপস্থিত। পতিপ্রাণা আবার স্বাধীনচেতা হয়ে মদিনাসুন্দরীরা উপেক্ষা করতে জানে দয়িতের প্রিয় সম্ভাষণ। আবার প্রেমের স্রোতে নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করতে জানে। পুরুষকে প্রিয়রূপে যেমন জীবন রক্ষা করতে জানে তেমনি জানে নারীত্বের লাঞ্ছনাকারীকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে। এই দ্বিবিধ বৈশিষ্ট্যে এই লোকায়িত জীবনের নায়িকারাই লৌকিক আবরণ স্বীকার করেই আধুনিক সমযের পরিবৃত্তে স্থান করে নেয়। পাকাপোক্ত করে নেয় নিজেদের আসন। সময়ের বেষ্টনী ত্যাগ করে যখন তারা বর্তমানের বৃত্তে অবস্থান করে, মিশে যায় বঙ্গনারীদের জীবনবৃত্তের পরিধিতে, মননে ও চেতনায় সমকালকে একসূত্রে গেথে নেয় তখনই কাব্যের বৃত্ত হয় সম্পূর্ণ। এই পূর্ণতার নির্মাণেই কাব্যের সার্থকতার বীজ রয়েছে।নারীত্বের এই নির্মাণ ও বিনির্মাণ অভিনব ও গতিশীল সময়ের ধারক একথা স্বীকার করতেই হয়।

Exit mobile version