শিক্ষার মতি-গতি সুষ্ঠু হবে কবে

আপডেট: ডিসেম্বর ৪, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির

আমরা যারা শেখার চেষ্টা করছি এবং যাঁদের শেখানোর ভার অর্পণ করছি, তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার ইতিহাস জানার প্রয়োজন অনুভব করি না। অজানা ইতিহাসের অন্ধকারে কেবল কালো বিড়াল খুঁজি। ফলে ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন শিক্ষা ভাবনা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে বৃহত্তর শিক্ষাগ্রহী শিশু-কিশোর-তরুণ ভেড়ার মত চলতে চলতে একসময় গজমূর্খ হয়ে পয়সার পেছনে ছোটে; প্রকৃত শিক্ষা নোট বটিকার প্রাসাদে আটকা পড়ে যায়। এখান থেকে আমরা মুক্ত হবো কবে!

‘হাতমে বিড়ি মুহমে পান’ বলে আমরা ‘পাকিস্তানের অভাব কি’ এর দিবাস্বপ্ন দেখলাম। ফল হলো শূন্য! স্বাধীন দেশে আমরা শিক্ষা নিয়ে কম লুকোচুরি খেলিনি। তার চলচ্চিত্র এখনো বহমান। আমরা পাকিস্তান জুড়ে ‘কওমি তমাদ্দুনের’ শিক্ষা ভার অর্পণ করতে চেয়েছি নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর। কওমি তমুদ্দুন কী? উত্তর খুঁজেছি ‘মুসলিম হায় হাম ওয়াতান হায় সারা জাহান হামারা’ আসলে কবি ইকবাল লিখেছিলেন ‘হিন্দি হায় হাম’ তা যেন, ‘মহশ্মশানকে গোরস্থানে’ পরিবর্তনের মতো হয়ে গেছে। আমাদের লাভ হয়নি। প্রকৃত শিক্ষা জাতির মর্মমূলকে আলোড়িত করতে পারেনি। আমরা শিক্ষক সমাজ অর্থ-সম্পদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছি এবং ব্যক্তিগত সুখের জন্য জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবিনি। একে তরান্বিত করার জন্য যাবতীয় অপকৌশলের ফাঁদে পা দিয়েছি, এতে প্রকৃত শিক্ষা ছুটি নিয়ে দেশান্তরিত হয়েছে। তাঁদের ফিরিয়ে এনে সসম্মানে আসন দিতে হবে।

বেশিদূর যাব না। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনায় আমাদের উজ্জীবিত করতে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ২৫শে জুলাই শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শিক্ষা কমিশন উদ্বোধন করেন। নেতৃত্বে ছিলেন ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা। সদস্যবৃন্দের অনেকেই আমাদের জানা-শোনার মধ্যে ছিলেন। ‘দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতির জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির উদ্দেশ্যে জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থায়? তবে জেনারেল আইউব খান কর্তৃক প্রবর্তিত বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল থাকে। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ছিলো। প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের উন্নয়নের জন্য এক সাথে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয়। পরিণতিতে ভেজালে সয়লাব হয়ে যায় প্রাথমিক শিক্ষার বাঁধন। আর কিছু শিক্ষক নিয়োগ কর্মকর্তা লালে লাল হয়ে ওঠে অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে।

আজও যার রেশ বহন করে চলেছে বৃহত্তর সমাজ। রং ঢং পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু ভিত্তি সুদৃঢ় হয়নি। এমনিভাবে ওপরের শ্রেণিগুলোও জ্ঞানের ঢেউয়ে খাবি খায়। এই খাবি খাওয়ায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। একদার বহুমুখীকে আবার একমুখী করার জোর কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। যেন সেই ‘থোড়বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।’ না ঘরকা, না ঘাটকা। আসল ব্যাপার শিক্ষা নিয়ে এই হেরফের কার্যকর করতে গেলে দেখতে হবে শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থাকে। মোটামুটি জীবন অনুষঙ্গি শিক্ষা দানে ভাষা ও বিষয় সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তি আমাদের কাছে শিক্ষক নামে পরিচিত। এ পর্যায়ে নিম্নপ্রাথমিক পাস করা ব্যক্তিবর্গ একদা শিক্ষক হতেন। সৌভাগ্য, এমনতর শিক্ষকের কাছে আমার বাল্যশিক্ষার সূচনা। সেটা দেশভাগের কিছু আগে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে এঁদের কেউ কেউ ছিলেন।

পরে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করলে নতুন শিক্ষক নিয়োগে যে হযবরল শুরু হলো, তা শেষ হয়নি। কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় নয় বিশ্ববিদ্যালয়েও তা সংক্রমিত হয়েছে। এখান থেকে জাতি কতটুকু আশা করতে পারে নিবিড় শিক্ষা প্রাপ্তির। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যাকে-তাকে, যেখানে সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামের কিছু অবকাঠামোয় জড়ো হওয়া কিছু ব্যক্তিকে সরকারের আয়ত্তে আনা। জাতি স্তম্ভিত হয়, কিন্তু খেতাব প্রাপ্তরা উল্লসিত হয়ে শিক্ষার মূল লক্ষ্য স্মরণ করতে পারে না।

একদা দেশে ভালো মূল-কলেজের সংখ্যার চেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত হয়েছে। লাভ হয়েছে গুটিকয়েক ব্যক্তির। যাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন, তাঁদের জ্ঞানের জরিপ হয় না অনেকের। দুর্ভাগ্য সব বোঝা বহন করতে হয় জনগণকে। এঁরা অন্ধকার উত্তরণের পথ পায় না। সুতরাং আগে যথাযথ শিক্ষক নির্বাচন, পরে প্রতিষ্ঠান প্রবর্তন ও প্রয়োজন মনে করে বিভাগ গড়ে তুলে শিক্ষার অবগুণ্ঠিত দ্বার উন্মোচন করতে পারলে শিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হবে। শিক্ষার্থীরা আত্মঘাতী শিক্ষার কবলে পড়ে জীবনঘাতি হবে না।
একটা অনিবার্য সত্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে। শিক্ষক বেছে নিয়োগ দিতে হবে। কোটা বর্জন করতে হবে। পরে বর্জনীয় মনে করলে পদোন্নতি শেষ করতে হবে। এককথায়

নির্ভেজাল শিক্ষক নিয়োগ জাতিকে অবশ্যই উন্নয়নের পথ দেখাবে।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

Exit mobile version