এমপি আনারের মৃত্যু নিয়ে রহস্য II মরদেহ পায়নি কোলকাতা পুলিশ II ধারনা খণ্ডখণ্ড করা হয়েছে দেহকে

আপডেট: মে ২২, ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক:


কলকাতায় আনোয়ারুল আজিম আনারের নিখোঁজ হওয়া ও হত্যাকাণ্ড এখনও রহস্যে ঘেরা। যে ফ্ল্যাটে এমপি আনার খুন হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে, সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে কোলকাতা পুলিশ। তাকে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের যে অ্যাপার্টমেন্টে সবশেষ দেখা গিয়েছিল, সেখানে রক্তের দাগ পেয়েছে পুলিশ। বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করেছে।

বুধবার (২২ মে) ভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে এবিপি আনন্দ জানিয়েছে, তার মরদেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কলকাতা সংলগ্ন অভিজাত এলাকা নিউটাউনের সঞ্জিভা টাউনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমের ভিতরে রক্তের ছাপ পাওয়া যায়।

দেশটির আরেক সংবাদ-মাধ্যম এন.ডি.টিভি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতা পুলিশ বুধবার (২২ মে) আনোয়ারুল আজিম’র খোঁজে তল্লাশি অভিযান শুরু করেন। এখনও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, উদ্ধার করা যায়নি। তবে, বাংলাদেশি এই এমপি খুন হয়েছেন বলে ধারণা করছে কলকাতা পুলিশ। তার মরদেহ কলকাতার নিউ-টাউন এলাকায় ফেলে রাখা হয়। তল্লাশি অভিযান’র সময় তারা নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছেন এবং এই ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন এমপি আনার।

ভারতীয়-ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়া টুডে জানায়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা আ’লীগ সভাপতি আনোয়ারুল আজিম গত ১২ মে সন্ধ্যা ৭টায় কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে যায়। পরের দিন (১৩ মে) চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১:৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি।

চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিম তার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দিতে সতর্ক করেন।

গত ১৫ মে হোয়াটস-অ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন ও ভিআইপিদের সাথে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেয়। বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত-সহকারী রউফের কাছেও একই বার্তা পাঠিয়ে দেন।

১৭ মে আনোয়ারুলের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে বলেন, আনারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিনই ঢাকার থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনোয়ারুলের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

ভারতের পুলিশের একটি সূত্র ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, বাংলাদেশে গ্রেপ্তারকৃতদের মঝে একজন জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। কলকাতার পুলিশ কর্তৃপক্ষকেও একই কথা জানানো হয়।

তবে, নিউ টাউনের কোনো এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি বলে জানিয়েছে ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমও। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, এই ঘটনায় বিধাননগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় তদন্ত করছে।

আনন্দবাজার অনলাইন জানিয়েছে, কলকাতায় পরিকল্পনামাফিক খুন করা হয়েছে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে। যদিও এখনও (বুধবার রাত আটটা পর্যন্ত) বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এই ঘটনার তদন্ত করছে কোলকাতার সিআইডি। নিউটাউনের অভিজাত আবাসন এলাকাও পরিদর্শন করেছেন সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী।

অখিলেশ বলেন, নিখোঁজের তদন্ত চলছিল। তার মধ্যে ২২ মে আমরা জানতে পারি, সাংসদকে খুন করা হয়েছে। শেষবার যেখানে তাকে দেখা গিয়েছিল সেই জায়গাটি খুঁজে বের করেছে স্থানীয় থানার পুলিশ। এরপরে সিআইডিকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে।

সিআইডি জানিয়েছে, নিউটাউনের যে আবাসনে আনোয়ারুল আজিম ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে, সেই ফ্ল্যাটটির মালিক সরকারি কর্মচারি। তিনি আবার আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেন। সিআইডির আইজি অখিলেশ জানান, আখতারুজ্জামান আমেরিকার নাগরিক। কিন্তু আখতারুজ্জামানের নামে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে কী করে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য থাকলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে অখিলেশকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি জবাব দেননি।

আনওয়ারুল যে নিউটাউনের ফ্ল্যাটে আছেন, তা জানা গেল কী ভাবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে অখিলেশ বলেন, ‘১৮ তারিখে একটি নিখোঁজ অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তারপর ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট একটি এসআইটি গঠন করে। সেই তদন্ত করতে গিয়েই আমরা খবর পাই। নিউটাউনের আবাসনের ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যেই নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। রক্তের দাগ বাংলাদেশের সংসদ সদস্যেরই কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। সিআইডি কর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের দেহ এখনও উদ্ধার হয়নি।

এদিকে এমপি আনোয়ারুলের মৃতদেহ কোথায় তা নিয়ে নানা মহলে ধোঁয়াশা বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, তার মরদেহ খণ্ড বিখণ্ড করে বাইরে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। যদিও এই বিষয়ে কোনো রকম মন্তব্য করেনি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কিংবা সিআইডি। এমপি আনোয়ারুল আজিমের দুটি ফোন নাম্বার যে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ঝাড়খন্ড সীমান্তে লোকেশন দিয়েছিল সেই বিষয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে সিআইডি। দুর্বৃত্তরা এমপির মরদেহ গুম করার উদ্দেশ্যে অন্যরাজ্যে নিয়ে গেছে কিনা তা নিয়েও তদন্ত চলছে।

এই ঘটনার পর কঠোর নিরাপত্তা মধ্যে পুরো সঞ্জিভা আবাসন বিধাননগর পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এই মুহূর্তে আনোয়ারুল আজিম আনার আবাসনের যে রুমে ছিলেন সেই রুমে পুলিশ এবং সিআইডি তল্লাশি চালিয়েছে।

আনোয়ারুল আজিম আনার নিখোঁজ হওয়ার পর কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠন করে তদন্ত শুরু করলে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। যাদের আটক করেছিল তাদের মধ্যে দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে রাজারহাট নিউটনের সঞ্জীবা টাউনের খোঁজ পাওয়া যায়। কলকাতার পার্শ্ববর্তী শহরাঞ্চল রাজারহাট নিউটনের সঞ্জীবা টাউনে আসেপাশে রয়েছে বস্তি অঞ্চল। এই অঞ্চলেই অন্যতম অভিজাত আবাসন এটি। ওই আবাসনের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে, গত ১৩ মে এই আবাসনে উঠেন আনোয়ার। তার সাথে ছিলেন আরও তিনজন ব্যক্তি, যার মধ্যে ছিলেন একজন নারী। এরপর থেকে আনোয়ার আবাসনের বাইরে না বেরোলেও বাকিরা বেশ কয়েকবার বাইরে বের হন।

পরিকল্পিতভাবে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে খুন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বুধবার (২২ মে) দুপুর দেড়টার দিকে নিজ বাসায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রী।

তিনি বলেন, কারা কারা খুন করেছে তা জানতে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ কাজ করছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটক তিনজন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে মন্ত্রী জানান, খুনের সাথে ভারতের কেউ জড়িত নয়। বাংলাদেশিরাই খুন করেছে। সেহেতু বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ভারত আমাদের যথেষ্ট কোঅপারেশন করছেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে আরো তথ্য রয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন জানাতে পারছিনা।

থানায় হত্যা মামলা
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার ঘটনায় ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। বুধবার (২২ মে) আনোয়ারুলের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আহাদ আলী জানান, বুধবার সন্ধ্যায় শেরে-বাংলা নগর থানায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হকও মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এমপি আনার সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে গেছেন। তাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে ডরিন। মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন জানান, আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চায়। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ধৈর্য ধরও বিচার হবে।

প্রধানমন্ত্রীর শোক
সংসদ সদস্য ও ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ-উপজেলা আ’লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজিম-আনার’র মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার (২২ মে) দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান আ.লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর ১৬ মে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। পরে ১৮ মে থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন সংসদ সদস্যের পরিচিত ভারতের বরানগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। এরপর আনোয়ারুল আজিম আনারের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে কলকাতা পুলিশ।

আনোয়ারুল আজিম আনারের জন্ম ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে। পেশায় ব্যবসায়ী আনার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কালীগঞ্জ উপজেলা সভাপতি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে তিনবার (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নির্বাচিত সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার একজন ক্রীড়া সংগঠক এবং এক সময়ের জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড়। ছাত্রজীবনে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ফুটবলে তার নেতৃত্বাধীন দল কালীগঞ্জ সরকারি ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

ছাত্রজীবন থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ নিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। স্থানীয় পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচন দিয়ে ভোটের রাজনীতি শুরু করেন তিনি। এর আগে বিশাল ভোটের ব্যবধানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও তিনি জয়ের ব্যবধান দিয়ে একই জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রাখেন।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় কখনও তাকে পুলিশি প্রটোকল ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। তিনি নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে দিন অথবা রাতে যখন প্রয়োজন তখনই নির্বাচনি এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে কোনও গ্রামে পৌঁছে যেতেন।