ঠা ঠা বরেন্দ্রে পানির সঙ্কট

আপডেট: এপ্রিল ২৪, ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ


মাহী ইলাহি:


বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর নামছে পানির স্তর। সেই সাথে বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে তাপমাত্রা। প্রতি বছর তাপপ্রবাহ শুরু পর রাজশাহী অঞ্চলে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। সুপেয় পানির জন্য হাহাকার সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে। টানা দাবদাহের কারণে ভুট্টা ও পাটসহ নানা ধরনের ফসলের আবাদ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সেচ সঙ্কটে পড়েছে বোরো ধানের খেত। ঝরে পড়ছে গাছের আম। ছোট অবস্থাতেই ফেটে যাচ্ছে লিচু। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অঞ্চলের অর্থনীতি।

উত্তরাঞ্চলে পানির সঙ্কট বেশি তানোর উপজেলায়। এই উপজেলা বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর থেকে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নওগাঁ ও নাটোরের প্রায় সব উপজেলাতে খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে।

তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার একটি বড় এলাকাজুড়েই পানির সঙ্কট দীর্ঘদিনের। এখানে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের মাহালী সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে তাদের গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার জন্য পানি আসতে হয়। একই চিত্র বাঘা উপজেলার শিমুলিয়া এবং পাটিয়াকন্দি গ্রামে। টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে গত ২০ দিন থেকে পানি উঠছেনা। এসব গ্রামের মানুষকেও পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্তে ছুটতে হচ্ছে। গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের নাম ‘পানি’। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ থাকলেও সেগুলো থেকে এখন পানি আর মিলছে না। অনেকেই দুর গ্রাম থেকে পানি নিয়ে আসছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, দুর গ্রাম থেকে পানি আনতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটে এক নারীর। এ অবস্থায় অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। পাঁচন্দর মাহালীপাড়া গ্রামের অনেক আবাদি জমি সেচের অভাবে অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

শুধু তানোর ও বাঘা নয় রাজশাহী মহানগরীতে পানির এখন এমন সমস্যা হচ্ছে। নগরীর শিরোইল এলাকায় বেশ কয়েকটি টিউবওয়েল থেকে পানি ঠিক ভাবে উঠছে না। এখানকার মঠপুকুর এলাকার আহলে হাদিস জামে মসজিদের টিউবওয়েলেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। একই অবস্থা উপশহরসহ বিভিন্ন এলাকায়।

বাঘা উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী মিঠন কুমার রবিদাস জানান, উপজেলায় দুই হাজার ৯৫১টি টিউবওয়েল বসানো আছে। এরমধ্যে ৫২৭টি টিউবওয়েলে বর্তমানে পানি উঠছে না। সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। গেল শীতেও এই টিউবওয়েল থেকে পানির সংগ্রহ করেছিল গ্রামের মানুষ।

রাজশাহী জনস্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী প্রকল্প চালু হওয়ার পর অনেক সংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। পানির স্তর সংকটে রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৪০টি ইউনিয়ন সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার ৭টি করে মোট ১৪টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ২টি ও নাচোল উপজেলার ৪টি, ভোলাহাটের ১টি, গোমস্তপুর উপজেলার ৫টি, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার, মহাদেবপুর উপজেলার ১০টি, নাটোরের ৩টি, জয়পুরহাটের ৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। এ ছাড়া অল্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ২৭টি ইউনিয়ন। ওই সকল ইউনিয়ন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে থাকায় পানির স্তর নিচে রয়েছে।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং পানির সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলগুলোর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৫টি উপজেলায় এই সমীক্ষা চালানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে পানির সঙ্কটাপন্ন এলাকা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুটে। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ভূগর্ভস্থ পানির গড় ২০২১ সালে আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ হতে মাটির নিচে পানি নামে ১৫৩ ফুট।

গত বছর ১৬০ ফুট নিচে এই পানির স্তর নেমেছে। এ অঞ্চলের ২১৪ টি ইউনিয়নের মধ্য ৮৭ টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ৬ ও নাচোলের ৪ ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা।

রাজশাহী জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজশাহীর নয়টি উপজেলার পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেমেছে তানোর ও গোদাগাড়ীতে। এই দুই উপজেলায় ৯২ ফুট পানির স্তর নেমেছে। এরপর আছে মোহনপুর ও পবা। এই দুই উপজেলাতে ৮২ ফুট পানির স্তর নেমেছে। বাগমারা উপজেলায় পানির স্তর নেমেছে ৬০ ফুট, বাঘা ও দুর্গাপুর উপজেলায় ৪৩ ফুট। পুঠিয়ায় নেমেছে ৩৮ ফুট ও চারঘাটে ৩৭ ফুট।

দুই-তিন দশক পূর্বে রাজশাহীসহ শুষ্ক বরেন্দ্রভূমিতে ভূগর্ভের ৬০-৭০ ফুট নিচে পানির স্তর অবস্থান নিশ্চিত করা যেত। এসব নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তবে গত তিন দশকে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও নীতিমালা অমান্য করে বহু গুনে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। যার ফলে প্রয়োজনের তুলনায় গভীর নলকূপের ঘনত্ব বৃদ্ধির কারণে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আবদুর রশীদ জানান, শুধু বিএমডিএ একা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে না। ব্যক্তি পর্যায়েও ডিপ ও সেমিডিপের মাধ্যমে পানির উত্তোলন করা হচ্ছে। বিএমডিএ নতুন করে গভীর নলকূপ না বসানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পদ্মা ও মহানন্দার পানি এনে সেচের ব্যবস্থা, জলাধার খনন, সংস্কার, পানির অপচয় রোধসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া খাল খনন করে ভূ-উপরিস্থ পানির আধার তৈরি করা হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল এই অঞ্চলের পানির ভবিষ্যৎ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করে আসছেন। তিনি বলেন, গত বছর বৃষ্টিপাত এমনিতেই কম হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়েনি। গত বছরের সঙ্কট কাটেনি। গত বছর বলা হয়েছিল আগামী বছর কৃষকরা পানি পাবে না। এখন প্রলম্বিত তাপপ্রবাহ চলছে। এ বছর তাই প্রচণ্ড খরা হবে। গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে ২গুণ হারে। খরা মৌসুমে Ground Water লেবেলে পানিই থাকছে না। মরুভূমির দেশগুলোতে বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলে অতি বৃষ্টি-প্রবণ বাংলাদেশের এলাকাগুলোতে বৃষ্টির দেখা নায়। এ বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো ৪ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) যে সংখ্যক ডিপ স্থাপন করেছে তার দ্বিগুণ ডিপ এই অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্য এই অঞ্চলে পানি থাকবে না মাটির নিচে।

সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, গ্রাউন্ট ওয়াটার রিচার্জ করা ও সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টির পানির অপচয় না করে এই পানিকে কার্যকরভাবে মাটির নিচে পৌঁছে দিতে হবে। আর নদীনালার পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেচে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য নদীনালা, খালবিল খনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।