রাবি ভর্তি পরীক্ষা : পরিবহণ ও আবাসন নৈরাজ্যের চিত্র একই রকম! রুম ব্যবসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও!

আপডেট: মার্চ ৬, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:প্রতিবছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগে নানা প্রস্তুতির কথা শোনা যায়। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ নানা প্রস্তুতির বাইরে মেস মালিক, পরিবহণ মালিক, হোটেল মালিকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজশাহী সিটি করপোরেশনও নানা সিদ্ধান্ত নেয়। মেস মালিক, পরিবহণ মালিক, হোটেল মালিকরাও সে আলোচনায় দুর্ভোগহীন সেবা দেওয়ার নানা আশ^াস দেন। কিন্তু সে আশ^াস ও পরীক্ষা শুরু হওয়ার পরের চিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া অনেকটা ‘ডুমুরের ফুল’র মতোই! এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষাকে সামনে রেখে শিক্ষানগরীখ্যাত রাজশাহীতে পরিবহণ ও আবাসন নৈরাজ্যের চিত্র এবারও বদলায় নি! বরং এবার বিশ^বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী রুম ব্যবসায়ে যুক্ত হয়ে ভর্তিচ্ছুদের ‘পকেট কাটছেন’!

পরিবহণ ও আবাসন নৈরাজ্যের মঙ্গলবার (৫ মার্চ) থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতক শ্রেণিতে প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত চার শিফটে ‘সি’ ইউনিটের (বিজ্ঞান) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯ টার পরিক্ষায় অংশ নিতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সকাল ৮ টার আগেই বাসা থেকে বের হয়েছেন। তারপরও তীব্র যানজটের সম্মুখীন হয়েছেন। তবে দুর্ভোগের শুরু যানজট দিয়ে নয়। বরং পরিবহণ ও আবাসন দিয়েও।

ভর্তি পরিক্ষার্থী ও তাদের স্বজনদের ভাষ্য, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে গত এক মাস থেকেই আসা-যাওয়া ও থাকার পরিকল্পনা করছেন। তবে যারা একটু দেরি করেছেন, তারা চরম দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন। আর এতো অগ্রিম পরিকল্পনার পরেও ন্যায্যমূল্যে হোটেল কিংবা মেস পান নি। অনেকে দূরপাল্লার টিকিটও কেটেছেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে।

রাজবাড়ী জেলা থেকে ছোট ভাইকে বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে নিয়ে এসেছিলেন রাসিব মোস্তফা। তিনি জানান, গত দুই সপ্তাহ থেকে তিনি রাজশাহী আসার টিকিট ও এখানে থাকার মতো রুম খুঁজছিলেন। টিকিট তো সোনার হরিণ। আর তার চেয়েও দামি আবাসন। কোথাও কোনো সিট নেই। বাধ্য হয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় অনেক কষ্ট করেই রাত কাটাতে হয়েছে। কিন্তু যাদের রাজশাহীতে কেউ নেই, তাদের কী অবস্থা!

ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে নগরীতে আবাসন ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। এবার মৌসুমি কথিত উদ্যোক্তার দেখা মিলেছে। যারা বিশ^বিদ্যালয়েরই অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। পূর্বে নিজের সিটটি ভর্তিচ্ছুদের ছেড়ে দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘পকেটকাটা’ ব্যবসায়ের খাতায় নাম লেখানো নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের পরিচয় পুঁজি করে এরা আবাসনের সুব্যবস্থা করতে না পারলেও এক রাতে একেক জন পরীক্ষার্থীর থেকে বাগিয়ে নিচ্ছেন দুই থেকে তিন হাজার টাকা।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের কয়েকজন বন্ধু মিলে এই ব্যবসায় নেমেছেন। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কাস্টমার খুঁজছেন। যোগাযোগ করা হলে এদের একজন জানান, ভর্তি পরিক্ষাকে সামনে রেখে তারা নগরীতে, যেটি বিশ^বিদ্যালয়ের অদূরেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে খাটসহ বাসা-বাড়ির মতোই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর তারা এক রাতের জন্য আড়াই হাজার টাকা নিচেছন। আর কেউ খাবারের ব্যবস্থা চাইলে সেটাও করে দিচ্ছেন। এরজন্য খাবারের বিল দিতে হবে। আড়াই হাজার টাকায় শুধু থাকার ব্যবস্থাই করা হচ্ছে।
এদিকে, নগরীর মেসসহ হোটেলগুলোতেও একই নৈরাজ্য চলছে। নজরদারি আদৌ আছে কী না তা বোঝার উপায় নেই।

ভর্তি পরিক্ষার প্রথম দিনে হোটেল হক ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় রুম নেয়ার জন্য। তারা জানান, তাদের সাধারণ সব রুম বুক হয়ে গেছে। এসি রুম ফাঁকা আছে। যার ভাড়া চাওয়া হয় একরাতের জন্য ৫ হাজার টাকা। অথচ অন্য সময় এই ভাড়া থাকে ২ হাজার টাকা। একই চিত্র হোটেল আনজুম ইন্টারন্যাশনালেও। ১ হাজার ১০০ টাকার ভাড়া চাওয়া হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু এই দুই আবাসিক হোটেলই নয়; নগরীর অধিকাংশ হোটেলের চিত্র একই!

মেয়েকে নিয়ে পরিক্ষা দিতে বাধ্য হয়েই দ্বিগুণ ভাড়ায় রুম নিয়েছেন আঞ্জুমান আরা। তিনি জানান, হোটেল ভাড়ার মেমোতে লিখে দিয়েছে এক রাতের ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু তার কাছে ভাড়া নেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। তার প্রশ্ন, এক রাতেই যদি ৪ হাজার টাকা থাকার জন্য খরচ করতে হয়; তাহলে মেয়েকে কিভাবে অন্য বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দিতে নিয়ে যাব?
তবে এ অভিযোগগুলো মানতে নারাজ রাজশাহী আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার হাসান কবির। তিনি বলছেন, হোটেলের ভাড়া পূর্ব নির্ধারিত। বেশি নেয়ার কোনো সুযোগ নেই ।
রাজশাহী মেস মালিক সমিতির সভাপতি এনায়েতুর রহমান জানান, রাজশাহী শহরে ৪ হাজারের বেশি মেস আছে। এরমধ্যে ২ হাজার ২০০ মেস তাদের সংগঠনের অধীনে। সংগঠনের অধীনে থাকা মেসগুলো তারা নজরদারি করছেন। তবে একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাধিক অভিভাবক আসছেন। একারণে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে।

শুধু আবাসন নয়, পরিবহণ চালকরাও যেন সুবর্ণ এক সুযোগ পেয়েছেন। যা ভর্তি ছাড়া অন্য সময়ে তেমন একটা দেখা যায় না। যাটজটের তকমা লাগিয়ে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে পাঁচ-দশগুণ পর্যন্ত। যারা রাস্তা চেনেন, তারা অনেকে পায়ে হেঁটেই বিশ^বিদ্যালয়ে যাচেছন। আর যারা প্রথমবার এসেছেন তারা ১০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকাও গুণছেন।

দিনাজপুরের বাসিন্দা রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থী আবু সাইদ জানান, তার এলাকার দুই ছোট ভাই পরিক্ষা দিতে রাজশাহীতে এসেছেন। সকালে বলে দিয়েছিলাম, ভদ্রায় অটোতে উঠে কাজলায় যাবো বললেই হবে। ভাড়া ১০ টাকা নিবে। পরিক্ষার পূর্ব মুর্হূতে যানজট ও দীর্ঘ সময়ের অজুহাত দেখিয়ে ১০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) এর অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) জামিরুল ইসলাম বলেন, বিষয়গুলো আমাদেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা নির্দিষ্টভাবে যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছি, সেগুলো সমাধান করছি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

উল্লেখ্য, রাবিতে ৪ হাজার ৪৩৮টি আসনের বিপরীতে মোট ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৬৮০জন শিক্ষার্থী লড়াই করছেন। প্রথম দিনে ‘সি’ ইউনিট (বিজ্ঞান) ৭০ হাজার ৯৭৬ পরিক্ষার্থী অংশ নেয়। বুধবার ‘এ’ ইউনিট (মানবিক) এবং বৃহস্পতিবার ‘বি’ ইউনিট (বাণিজ্য) ও ‘সি’ ইউনিটের (অবিজ্ঞান) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ