বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ II মাটি ও মানুষের সাথে মিশে একাকার যে দল

আপডেট: জুন ২৩, ২০২৪, ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


বাংলাদেশের গণমানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। বাঙালি জাতির লড়াই-সংগ্রামের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, চড়াই-উৎরাইয়ের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে দলটির নেতৃত্ব মাটি ও মানুষের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। ঐতিহ্য আর গৌরবগাথায় বিশ্বের আর কটা রাজনৈতিক দল রয়েছে, যে দলটি মানুষের প্রতিটি স্পন্দনে, রাগে-অনুরাগে, আবেগ-উচ্ছ্বসে, নির্মাণ সৌষ্ঠবে, অর্জনে-বিসর্জনে, প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় ক্রিয়াশীল রয়েছে? ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের অভ্যুদয়Ñ এর সবই তো আওয়ামী লীগের অগ্রভাগ নেতৃত্বের সাফল্যগাথা। আওয়ামী লীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত শতাব্দীর মহান নেতাকে সৃষ্টি করেছে। আবার সেই শতাব্দীর স্পর্ধিত পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে বাঙালি জাতির শেকড়-গভীর সংগঠনে পরিণত করেছেন। আওয়ামী লীগের ৭৫ তম বার্ষিকীতে এই মহান নেতাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছে জাতি।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক সংগঠনটি ৭৫ বছর পূর্ণ করে আজ রোববার ৭৬ বছরে প্রবেশ করলো।

প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিব।
অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।
আওয়ামী লীগ ছিলো তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।

জন্মলগ্ন থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বিলোপ।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ বলে চিহ্নিত মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দল ভাঙনের ফলে আওয়ামী লীগ সংকটে পড়ে। ওই বছরের সাত ও আট ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মুজিব তার নেতৃত্বের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর ছয় দফা উপস্থাপন করেন। এর জবাবে আইয়ুব সরকার তিনিসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬৯ সালের তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতন হয়। এসব আন্দোলনের এক পর্যায়ে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

গণআন্দোলন ও আইয়ুবের পতনের পটভূমিতে ’৭০ এর নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ আসনেই জয়ী হয়। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি নারী আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি নারী আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় বাংলাদেশ যার সংঘটনে নেতৃত্ব দিতে হয় আওয়ামী লীগকেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পাঁচ বার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় দলটিকে। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন লাভ করে দলটি। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একটি মাত্র জাতীয় দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) গঠনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করা হয়।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার সরকারের পতন ঘটানো হয় । ক্ষমতায় আসা সামরিক সরকার রাজনৈতিক দল প্রবিধান ঘোষণা করলে ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটে। আওয়ামী লীগ সম্মেলন করে প্রবাসে থাকা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে হাসিনা দলের দায়িত্ব নেন। তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে, ২০০৯ সালে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, স্বপ্নের আকার দিচ্ছেনÑ অপরিমেয় সাহস দেখাচ্ছেন, জাতিকে সাহসের ওপর ভর করে দাঁড়াতে শেখাচ্ছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ