ভোটের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে মাহির ট্রাক II দলের নৌকা তীরে ভিড়েছে, ধার হারিয়েছে আস্থার কাঁচি

আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৪, ১১:০০ অপরাহ্ণ

মাহাবুল ইসলাম:


গণমানুষের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে প্রতিবাদের মন্ত্রে এগিয়ে চলা কাঁচি ধার হারিয়েছে শেষ বিকেলে এসে। মিছিল শ্লোগানে কিংবা ফটো সেশনে রূপালী পর্দা কাঁপানো চিত্র নায়িকার তুমুল জনপ্রিয়তা ভোটের ট্রাকে তুলতে পারেন নি। তবে ব্যক্তির প্রতি রাগ-ক্ষোভ, অভিযোগ ভুলে ব্যালটে ব্যক্তির চেয়ে প্রতীক ‘নৌকা’ বড় হয়ে উঠেছিলো। এতে ফারুক চৌধুরীর প্রতি আস্থা না থাকলেও প্রতীকে আস্থা রেখেছেন রাজশাহী-১ আসনের ভোটাররা। কারণ সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল পেয়েছে এখানকার মানুষ। আর এমপি ফারুক চৌধুরীর ব্যক্তি উদ্যোগে তেমন কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না থাকলেও সরকারের উন্নয়নের প্রভাব তার ঝুলিতে জমা পড়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। চৌধুরীর আচরণগত ত্রুটির ক্ষোভ এখনো দৃশ্যমান জনতার মাঝে।

সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়েছেন রাজশাহীর রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতন নাগরিকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ব্যক্তির প্রতি অভিমান-অভিযোগ থাকলেও ব্যালটে প্রধানমন্ত্রীর নৌকা বড় হয়ে উঠেছিলো। ফলে ব্যক্তির সব দোষ-ত্রটি- বিচ্যুতি ছাপিয়ে দলীয় প্রতীকেই যোগফল মিলিয়েছেন। এতে নির্বাচনি প্রচারণায় রাজপথ মুখরিত ‘চৌধুরী হটাও’ আন্দোলনের শ্লোগান ভোটের ব্যালটে হোঁচট খেল।

দেশের অন্যতম প্রাচীন এ বিভাগীয় নগরী রাজশাহীর সচেতন নাগরিদের মতে, এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের অগ্রভাগে থেকে হরেক কারণে সাধারণ জনগণের আস্থা কুড়ালেও ব্যালটে কাঁচি প্রতীকের রায়ে তার হিসাব মেলে নি। স্বতন্ত্রে মন্ত্রে বলিয়ান কাঁচি তার ধার আর ভার নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাছাকাছি পৌঁছালেও দলীয় প্রতীক নৌকা পাল তুলে তীরে ভিড়েছে। অর্থাৎ জেলা সদরের দুই উপজেলা তানোর-গোদাগাড়ীর ভোটারদের মাঠের আস্থায় কেন্দ্রে গিয়ে ধরে রাখতে পারেন নি প্রতিদ্বন্দ্বী ১০ প্রার্থীর কেউ।

এবারের নির্বাচনি প্রচারণায় ফিরে তাকালে দেখা যায়, রাজশাহী সদরে ‘চৌধুরী হটাও’ আন্দোলনের স্লোগান নির্বাচনি খেলার মাঠে দেশজুড়েই ছিলো আলোচনার শীর্ষে। আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়া নয়জন প্রার্থীর অধিকাংশই ছিলেন নানা কারণে আলোচনার মূখ্য ভূমিকায়। তারমধ্যে আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে ছিলেন ঢাকাই সিনেমার রূপালী পর্দা কাঁপানো নায়িকা মাহিয়া মাহি। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সর্বোচ্চ কভারেজ পাওয়ার সুবাদে নায়িকা মহিয়া মাহীর ‘ট্রাক প্রতীক’ ভিন্নমাত্রা পেয়েছিলো। তবে দিনশেষে নির্বাচনি খেলার মাঠে চৌধুরীর মাস্তানি ও কৌশলের কাছে ধরাশয়ী হতে হয়েছে মাহীসহ অন্যসব প্রার্থীদের।

রাজশাহীর সিনিয়র সিটিজেনদের মতে, জেলার ৬ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ভোটের বিবেচনায় তানোর- গোদাগাড়ীর জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আদিবাসী। প্রায় ৬৫ হাজারের বেশি আদিবাসী জনসংখ্যার মধ্যে ভোটার অর্ধলাখের কাছাকাছি। ফলে আদিবাসী ভোট ব্যাংক যে কোনো নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখে। এবারের নির্বাচনেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। আধিকার বঞ্চনায় সৃষ্ট ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারে নি আদিবাসী ভোটাররা। নেপথ্যে প্রাপ্ত অধিকার হরণের ভয়, নির্যাতিত হওয়ার শঙ্কা আর ভবিষ্যতে কাক্সিক্ষত সুবিধার প্রতিশ্রুতির বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন সমাজের সচেতন নাগরিকরা।

সাধারণ ভোটারদের ভাষ্যমতে, এ আসনে বর্তমান সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প তাদের জীবনমানকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু ব্যক্তি ফারুক চৌধুরীর কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় নি।

সমালোচকরা বলছেন, এমপি ফারুক চৌধুরী আকস্মিক নানান সিদ্ধান্ত ও কিছু আচরণগত ত্রুটি জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ভোটের বাক্সে এসব ক্ষোভের প্রভাব পড়লে বিজয়ের বিপরীতে পরাজয় ত্বরান্বিত করতে পারে বলে শঙ্কা ছিলো মুখে মুখে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই আসনে নৌকার হাল ধরে থাকা এমপি ফারুক চৌধুরীর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও সাধারণ ভোটাররা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ‘নৌকা’ প্রতীকে ভরসা রেখেছেন। এছাড়া রয়েছে কালো টাকার খেলা, ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগ।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে মাহিয়া মাহির ফোনে যোগাযোগ করে না পাওয়া গেলেও কথা হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আরেক আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়ার সাথে। তিনি বলেছেন,‘এমপি ফারুক চৌধুরী যে ‘ম্যাকানিজম’ করেছিলেন, তা আমরা পারি নি। একারণেই তিনি বিজয়ী হয়েছেন।’

আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাঁচি প্রতীকের গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। বেলা ১২ টার পর বড় ধরনের কারচুপি হয়েছে। আমার ৬০ হাজার ভোট চুরি করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও টাকার খেলায় ম্যানেজ করেছেন। আমার নির্বাচনী এজেন্টরা প্রাণ ভয়ে ভোট গণনার আগেই ফলাফল সিটে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে। এই নির্বাচনকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। পুনঃনির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।’

সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে গোদাগাড়ীর একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মোড়ল সরল এক্কা বলেন, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন চায়। তবে আমরা বাস্তবতার নিরিক্ষে সেই পরিবর্তন চেয়েছি। এমপি ফারুক চৌধুরী আমাদের জন্য একেবারেই যে উন্নয়ন কাজ করেন নি, এমনটা নয়। কিন্তু অন্যপ্রার্থীরা একেবারে নতুন বিধায় মিছিল মিটিংয়ে থাকলেও ভোটে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে নি অনেকেই।

রাজশাহী আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় বলেন, আদিবাসীরা সহজ-সরল জীবন যাপন করেন। নানান বিবেচনায় নির্বাচনে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকে। এবারেও প্রায় ৫০ হাজার আদিবাসী ভোটারের মধ্যে কমবেশি ৪০ হাজার ভোট দিয়েছে। আর এর এক তৃতীয়ংশই নৌকায় ভোট দিয়েছে বলে জানান এই আদিবাসী নেতা। তারমতে, এমপি ফারুক চৌধুরীর প্রতি অনেকে বিরাগভাজন থাকলেও শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নৌকায় ভরসা রেখেছেন, ভোট দিয়েছেন। অপরদিকে আদিবাসীদের সুখে-দুঃখে অতীতে কখনো পাশে না থাকলেও নির্বাচনের ডামা ঢোলে দেওয়া আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে পারে নি কেউ। আবার নানা কারণে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও শেষ হিসেবে পাল্টে গেছে।

রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম বলেন, “নিজের পক্ষে কিভাবে ফলাফল বাগিয়ে আনা যায়, তা এমপি ফারুক চৌধুরী ভালো করে জানেন। নির্বাচনি পরিবেশ ভালো ছিলো, জনগণের অংশগ্রহণও ছিলো। তবে ফলাফল নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। কারণ তার বাহিনীর কাছে প্রশাসন অসহায়।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম মাহমুদুল হক বলেন, ‘ওই আসনের নির্বাচন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয় নি। তবে এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিলো। তবে ফলাফল নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজশাহী-১ আসনের প্রচারণা দেশজুড়ে আলোচনায় ছিলো। এটা একটা পজেটিভ দিক হলো এখানকার মানুষের সমস্যাগুলো জোরালো ভাবে এসেছে। এখন একটা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের পেছনে অনেক কারণ থাকে। কালো অর্থের খেলা যেমন থাকে, তেমনি ভয়-ভীতিপ্রদর্শনসহ অনেক কিছুই করা হয়। তিনি আরও বলেন, এই আসনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো। সে সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে বিজয়ী প্রার্থীর ভোটের প্রার্থক্য বেশি নয়। সুতরাং ভবিষ্যতে জনগণের কল্যাণে কাজের বিষয়টা আরও গুরুত্ব পাবে।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আসনটিতে এবারে মোট ৪ লাখ ৪০ হাজার ২১৯ জন ভোটারের মধ্যে ৫১ দশমিক ৯৬ শতাংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এরমধ্যে এক লাখ তিন হাজার ৫৯২ ভোট পেয়ে চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। কাঁচিপ্রতীক নিয়ে ১১ হাজার ১৪৬ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী। তিনি পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪১৯ ভোট। ফলাফলে ক্ষুব্ধ রাব্বানী ভোটকার চুপির অভিযোগ করেছেন। এ আসনে মোট ১১ জনপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের এরমধ্যে মাহীসহ ৯ জনেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তানোর সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন।

মাহী ছাড়াও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী জামাল খান দুদু (সোনালিআঁশ) প্রতীকে ২৭৩ ভোট, বিএনএমের প্রার্থী মো. শামসুজ্জোহা (নোঙর) প্রতীকে এক হাজার ৯১১ ভোট, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শামসুদ্দিন (লাঙল) প্রতীকে ৯৩৮ ভোট, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সহধর্মিণী আয়েশা আক্তার জাহান ডালিয়া (বেলুন) প্রতীকে দুই হাজার ৭১৮ ভোট, এনপিপির প্রার্থী নুরুন্নেসা (আম) প্রতীকে ২৯৬ ভোট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের বশির আহমেদ (ছড়ি) প্রতীকে ৩৩৫ ভোট, বিএনএফের প্রার্থী মো. আল সা’আদ (টেলিভিশন) প্রতীকে ৬০৩ ভোট ও আখতারুজ্জামান আকতার (ঈগল) প্রতীকে ২০২ ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে আখতারুজ্জামান আকতার (ঈগল) শেষ পর্যন্ত ‘চৌধুরী হটাও’ আন্দোলনকে শক্ত করতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী গোলাম রাব্বানীকে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং কাঁচি প্রতীকে ভোট চেয়ে ‘চৌধুরী হটাও’ আন্দোলনকে বেগবান করতে স্বতন্ত্র অন্য প্রার্থীদের কাঁচি প্রতীকে সমর্থন দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ