রাজশাহীতে সমবায় সমিতির লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

আপডেট: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ১১:২০ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:


রাজশাহীতে একটি সমবায় সমিতির লাখ লাখ টাকা তছরূপ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবছর এই সমিতি শুধু ভাড়া বাবদই প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা আয় করে থাকে। কিন্তু বছরের পর বছর নিরীক্ষার সময় আয়ের হিসাব তুলে ধরা হয় কম। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সমিতির আয়-ব্যয়ের টাকার অংক সমান। এ নিয়ে সমিতিরই একজন সদস্য আদালতে মামলা করেছেন। বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা এ মামলায় কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ চার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।

এই সমিতিটির নাম রাজশাহী রিফিউজি কো-অপারেটিভ স’মিল লিমিটেড। এই সমিতির বয়স ৭১ বছর। ১৯৫২ সালে সমিতিটি নিবন্ধন পায়। এর নিবন্ধন নম্বর-২২। আইডি নম্বর ৮১২২০০৩৯১। এটি মূলত ভারত থেকে রাজশাহীতে আসা তৎকালীন মুহাজির বা রিফিউজি কাঠ মিল ব্যবসায়ীদের-সমিতি। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জেলা-প্রশাসক রাজশাহী নগরীর গোরহাঙ্গা এলাকায় প্রায় ১৪.৫০ কাঠা খাস জমি সমিতিটিকে ইজারা দেই। এখনও ওই ইজারা চলমান। রাজশাহী নিউমার্কেট সংলগ্ন এই জমিটি প্রধান সড়ক লাগোয়া। এটি এখন শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে।

এই জমিতেই কয়েকটি দোকানপাট ও কার্যালয় নির্মাণ করে রাজশাহী রিফিউজি কো-অপারেটিভ স’মিল লিমিটেড। প্রতিমাসে এসব দোকানপাট ও কার্যালয় থেকে ভাড়া ওঠে। সেই ভাড়ার টাকাই তছরূপ করা হয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে গত ১৫ এপ্রিল সমিতির সহসভাপতি মো. সোবহান বাদি হয়ে রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার আমলি আদালতে একটি মামলা করেন।

মামলায় সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী, সাধারণ সম্পাদক আসলাম পারভেজ, সদস্য সারফারাজ আব্বাস ও জুলেখা আব্বাসকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আবদুল জাব্বার আনসারী ও আসলাম পারভেজ সম্পর্কে দুই ভাই আর জুলেখা ও সারফারাজ হলেন সভাপতি জাব্বার আনসারীর-সন্তান। ৬ সদস্যের কমিটির মধ্য এই পরিবারটিই ৪টি পদ দখল করে আছেন। আর তাদের বিরুদ্ধেই সমিতির বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, শুধু ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ দুই অর্থবছরেই মামলার আসামিরা দোকান ভাড়ার ১৪ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা ও জামানতের ১২ লক্ষ ৯৪ হাজার ৯০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মামলা অনুযায়ী, সমিতি জিয়াউল হক নামের এক ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বছরে ৩৬ হাজার, খাজা বাবা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার, একটি দোকান থেকে ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার, একটি বিরিয়ানির দোকান থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার ও আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করে থাকে। প্রতি অর্থবছরে সমিতি ভাড়া থেকেই ৭ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা আদায় করে থাকে।

এ টাকা সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ অন্য দুই সদস্য ইচ্ছেমতো লুটপাট করেন। শুধু তাই নয়, সমিতির এই চার সদস্যই অনিয়ম করে সমিতিতে তাদের শেয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে সভাপতি আনসারীর শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৫৮০টি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৬৮০টি করে নেওয়া হয়। একইভাবে ছেলে সারফারাজ ও মেয়ে জুলেখার ১৩০টি করে শেয়ার ছিল। তা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৩০টি করে নেওয়া হয়েছে। জামাতা সাব্বির আহমেদের কোনো শেয়ার ছিল না। হঠাৎ কাগজে-কলমে তার শেয়ার ১ হাজার ২০০টি করে নেওয়া হয়। কীভাবে তাদের পরিবারের শেয়ার রাতারাতি বেড়ে গেছে তা সমিতির অন্য সদস্যরা কিছুই জানেন না। এক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি বলে অভিযোগ সমিতির অন্য সদস্যদের।

সমিতির সদস্য মো. আলমগীর বলেন, এই সমিতিতে মোট সদস্য আছেন ৪৫ জন। সমিতির আয় সদস্যদের কল্যাণে তাদের মাঝে বণ্টনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি-সম্পাদক তা করেন না। সমিতির আয়-ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে করার নিয়ম থাকলেও সেটাও করা হয় না। তারা আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবও কাউকে দেন না। ইচ্ছেমতো ব্যয় দেখিয়ে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর সমিতির লাখ লাখ টাকা তছরূপ করা হচ্ছে।’

অভিযোগের বিষয়ে সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী বলেন, আত্মসাতের অভিযোগ সঠিক না। সহসভাপতি মামলা করেছেন তা ঠিক। কিন্তু সবকিছু তো তাকে নিয়েই করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের শেয়ার নিয়ম মেনে বাড়ানো হয়েছে বলেও দাবি তাঁর।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরে শুধু ভাড়া থেকেই সংগঠনটি থেকে ৭ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকা আয় করে। কিন্তু সমবায়-কর্মকর্তা যে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন, তাতে এই আয় দেখানও হয় না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবমিলিয়ে ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৩৪৩ টাকা আয় দেখানও হয়। আর খরচও দেখানও হয় ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৩৪৩ টাকা। সভাপতি-সম্পাদক স্বাক্ষরিত এই আয়-ব্যয় হিসাব বিবরণী অনুমোদন দেন নিরীক্ষা কর্মকর্তা ও রাজশাহী মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা নাছিমা খাতুন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরেও ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার ৬০৩ টাকা আয় এবং একই পরিমাণ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। নিরীক্ষক ও মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কার্যালয়ের সহকারী-পরিদর্শক বিউটি রানী সাহা এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের স্বাক্ষর করা হিসাব বিবরণী-অনুমোদন দেন ।

মামলার বাদি মো. সোবহান বলেন, সমবায় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এভাবে সমিতির আয়-ব্যয় সমান দেখানো হয়। বাস্তবে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক বেশি। এই টাকা সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ কয়েকজন আত্মসাৎ করেন।
সমিতির সাধারণ-সম্পাদক আসলাম পারভেজ বলেন, সব হিসাবই তো অডিট রিপোর্টে দেয়া যায় না। বোঝেনই তো! নিজেদের মধ্য ভাগ করতে হয়।

বছর বছর আয়-ব্যয় সমান দেখিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতের ব্যাপারে মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা নাছিমা খাতুন বলেন, ‘সভাপতি-সম্পাদক যে হিসাব বিবরণী দেন, যাচাই-বাছাই করেই সেটা অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বেশি কোনো আয় হয়ে থাকে কি না তা জানি না।’