রাজশাহীসহ সারাদেশে হিট স্ট্রোকে সাতজনের মৃত্যু II আবারও তিনদিনের হিট অ্যালার্ট জারি

আপডেট: এপ্রিল ২৯, ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


রাজশাহীতে একদিনের ব্যবধানে আবারও অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। রোববার (২৮ এপ্রিল) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে শনিবার (২৭ এপ্রিল) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তীব্র তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সারা দেশ থেকে আকস্মিক মৃত্যুর খবর আসছে। রোববার (২৮ এপ্রিল) সারা দেশে ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহীর পবা উপজেলায় হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তার নাম দিলীপ বিশ্বাস (৩৫)। তিনি জেলার পবা উপজেলার দামকুড়া থানার কাদিপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছেন, দিলীপ বিশ্বাস একদম সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন। সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। তাই তারা ধারণা করছেন, বৈশাখের এই প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

রাজশাহীর দামকুড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মঈনুল বাশার জানান, খবর পেয়েই তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে দিলীপ বিশ্বাসের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেন। তারা বলেছেন, হিট স্ট্রোক করেই তাদের ছেলের মৃত্যু হয়েছে। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহের শেষকৃত্যের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামে হিট স্ট্রোকে মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী (৫৫) নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকালে চট্টগ্রাম নগরের বাসা থেকে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ-কুতুবী হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হোন। তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদরাসায়।

পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছেন, দিলীপ বিশ্বাস সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। রোববার সকালে হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। তারা ধারণা করছেন, বৈশাখের এই তীব্র গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।

যশোরে অব্যাহত তাপ প্রবাহে হিটস্ট্রোকে আহসান হাবীব (৩৭) নামে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি যশোর আমদাবাদ হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। এ নিয়ে যশোরে হিট স্ট্রোকে তিন জনের মৃত্যু হলো। এর আগে, যশোর সদর ও মনিরামপুরে ১ জন করে হিট স্ট্রোকে মৃত্য বরণ করেন।

আমদাবাদ হাইস্কুলের প্রধান-শিক্ষক এ.জেড.এম পারভেজ মাসুদ বলেন, শিক্ষক আহসান হাবীব সকালে মাঠে কাজ করে ৯ টায় স্কুলে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে আদালত প্রাঙ্গণে সুলতান উদ্দিন মিয়া (৭২) নামে এক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। রোববার দুপুর ৩টার দিকে তার মুত্যু হয়। তিনি নরসিংদী কোর্টে আইনজীবীর সহকারী (মুহুরি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, মৃত সুলতান উদ্দিন মিয়া সকালে প্রতিদিনের মতো বাসা থেকে বের হয়ে নরসিংদী কোর্টে যান। কোর্টে কাজ করার সময় দুপুরে তার বুকে ব্যথা অনুভব হয়। পরে সে আদালতের মসজিদের সামনে এলে পড়ে যান। লোকজন উদ্ধার করে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মাদারীপুরে তীব্র তাপপ্রবাহে অসুস্থ হয়ে দুইজন মারা গেছেন। নিহতদের একজন খুচরা ব্যবসায়ী ও অপরজন কৃষক। রোববার বেলা আড়াইটার দিকে জেলার কালকিনি উপজেলার পশ্চিম শিকারমঙ্গল এলাকায় ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী শাহাদাত সর্দার (৫৫) ও ২টার দিকে ডাসার উপজেলার কাজীবাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামের মোসলেম ঘরামি (৬০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মাদারীপুর’র অতিরিক্ত পুলিশ-সুপার আলাউল হাসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, প্রচণ্ড গরমে ২ জন মারা যায়ার খবর পেয়েছি। বিষয়টি খুবই দুঃখ-জনক।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হিটস্ট্রোকে হাবিবা রিক্তা নামে এক স্কুল শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে। নিহত স্কুল শিক্ষিকা হাবিবা রিক্তা টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বর্নি বাজার এলাকার জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী। সে উপজেলার ৯নং উত্তর বর্নী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

হাবিবা রিক্তার স্বামী জাহিদুল ইসলাম বলেন, গতকাল শনিবার (২৭ এপ্রিল) তিনি রোদের মধ্যে গরমে ধান সিদ্ধের কাজ করেছিলেন। রোববার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে বাড়িতে হঠাৎ করে হাবিবা রিক্তা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম জানান, রোববার সকালে রাজশাহীর তাপমাত্রা ছিল ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর ১২টায় তা বেড়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়ায়। বেলা ২টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বেলা ৩ টার সময় তা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেয় বলে তিনি জানান।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, সাধারণত দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। এছাড়া ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর উঠলেই তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সারা দেশে আরও ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট
সারা-দেশে মাঝারি থেকে তীব্র তাপ-প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আরো ৭২ ঘণ্টা অথাৎ ৩ দিন ধরে এই তাপ-প্রবাহ অব্যাহত থাকবে জানিয়ে হিট অ্যালার্ট জারি করে আবহাওয়া অধিদফতর। এ নিয়ে চলতি এপ্রিলে পঞ্চম দফায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা আসলো। রোববার (২৮ এপ্রিল) আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ আজ হতে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে।

আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ৭২ ঘণ্টার জন্য জারি করা এই সতর্কবার্তা থাকাকালীন সময়ে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। কিছু কিছু জেলায় তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে, মে মাসের শুরু নাগাদ রাজধানীসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

গত ১৯ এপ্রিল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রথমবার তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়। এরপর থেকে কয়েক ধাপে তা বাড়ায় আবহাওয়া অফিস।
হিটস্ট্রোকের লক্ষণ

* যখন কোনও ব্যক্তি দীর্ঘক্ষণ গরম-বাতাস ও সূর্যের আলোতে থাকে, তার মুখ ও মাথা দীর্ঘক্ষণ সূর্যের-আলো ও গরম বাতাসের-সংস্পর্শে এসে সান-স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন।
* হিট-স্ট্রোকের কারণে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে। হিট-স্ট্রোকের কারণে শরীরে পানি-শূন্যতার সমস্যা বেড়ে যায়।
* হিট-স্ট্রোকে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং তাপ শরীর থেকে বের হতে পারেনা। শরীরে ক্র্যাম্প দেখা দিতে পারে ও দুর্বলতা বাড়তে থাকে।
* হিট-স্ট্রোক এলে অজ্ঞান হয়ে যায়া ও মাথা ঘুরতে শুরু করে। ব্যক্তি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তার মানসিক অবস্থাও প্রভাবিত হয়েছে।
* হিট-স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে শরীর গরম ও লাল হয়ে উঠবে কিন্তু ঘাম হবেনা। সেই-সাথে হৃদস্পন্দন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বাড়তে থাকবে।

হিটস্ট্রোক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে যেভাবে
কেউ যদি দীর্ঘ সময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকেন তবে তিনি হিট স্ট্রোক বা সান স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। হিট স্ট্রোকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাপপ্রবাহের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মস্তিষ্ক, হার্ট , কিডনি ও লিভার এবং পেশী। বেশিরভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি কিডন‘কে প্রভাবিত করে। পানির অভাবে কিডনি ঠিক-মতো কাজ করতে পারেনা। যে কারণে শরীরে ইউরিক-অ্যাসিড’র মাত্রা বেড়ে যায়। হিট স্ট্রোকের কারণে রোগীর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই সচেতন হওয়া জরুরি।

সুস্থ থাকবেন যেভাবে
গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে বেশি করে পানি পান করতে হবে। সেইসঙ্গে পান করতে হবে বেশি করে ফলের রস এবং ওরস্যালাইন। তবে দিনে দুটির বেশি স্যালাইন পান করবেন না। ওরস্যালাইন তৈরির আগে প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা মেনে তবেই তৈরি করুন। শসা, তরমুজ ও ডালিম খাবেন নিয়মিত। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় গরমে থাকা এড়িয়ে চলুন। চেষ্টা করুন তুলনামূলক শীতল তাপমাত্রায় থাকার। পোশাক হিসেবে সুতির ঢিলেঢালা জামা ব্যবহার করুন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ