রাবির ভর্তিযুদ্ধ এবারও সক্রিয় জালিয়াতি চক্র

আপডেট: মার্চ ৫, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


মাহী ইলাহি ও সোহাগ আলী:রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধ শুরু হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল থেকে। এবার চার হাজার ৪৩৮ আসনের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন এক লাখ ৮৫ হাজার ৬৮০ জন পরীক্ষার্থী। প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হবে ‘সি’ ইউনিটের পরীক্ষা। দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠিত হবে ‘এ’ ইউনিট ও শেষদিন হবে ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষা। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে রাবি কর্তৃপক্ষ।
তবে প্রতিবারের মতো এবারও সক্রিয় আছে জালিয়াত চক্র। এবার তারা ধরন বদলিয়েছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে সজাগ অবস্থানে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

ভর্তিযুদ্ধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, জালিয়াতচক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কয়েকজন নেতা জড়িত। চক্রের সদস্যরা প্রক্সি ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে ভর্তিচ্ছুদের পরীক্ষায় সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আগের বছরগুলোতে রাবির ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সিকাণ্ডে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব কাণ্ডে ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী হারিয়েছেন ছাত্রত্ব, করেছেন কারাভোগও। তবুও ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের একটি সিন্ডিকেট এবারও ভর্তি জালিয়াতি করতে সক্রিয় রয়েছে।

দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত কয়েক দশকে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে এখানে ভর্তি জালিয়াতির অন্যতম প্রক্রিয়া হচ্ছে ‘প্রক্সি’। ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রবেশপত্রের ছবি পরিবর্তন করা হয়। জালিয়াত চক্রের সদস্যদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীরা ‘এক্সপার্ট’ নামে পরিচিত। রাবিতে প্রক্সি দিতে আসা এক্সপার্টদের অধিকাংশই ঢাকা থেকে আসেন। এ ছাড়া কিছু রাবির শিক্ষার্থীও রয়েছেন। পরীক্ষাপ্রতি একজন এক্সপার্ট পান এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত।

জানা যায়, গেল বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি ও অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে সাতজনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন কমিটির সহসম্পাদক হাসিবুল হাসান শান্তর নাম। প্রক্সিদাতাদের সঙ্গে ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চুক্তি করতেন তিনি। পরে গত বছরের ৩০ মে রাতে নগরীর কাটাখালী এলাকা থেকে তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।

রাবি ছাত্রলীগের আরেক নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের গত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। প্রক্সিকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২২ সালের আগস্টে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে একই বছরের নভেম্বরেই তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি পদেও ফেরানো হয় তাকে। কিন্তু গত বছরের আগস্টে এক প্রক্সি শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলে আটকে রেখে টাকা দাবির অভিযোগ আসে প্রক্টরিয়াল বডির কাছে। সেখানেও মূল হোতা হিসেবে উঠে আসে তন্ময়ের নাম। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম বাদী হয়ে তন্ময়সহ ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীর নামে নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন।

মামলার বাকি তিন আসামি হলেন বিশ্ববিদ্যায়ের শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, কর্মী শাকোয়ান সিদ্দিক প্রাঙ্গণ ও শহিদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী মহিবুল মমিন সনেট। গত বছরের আগস্টে তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরে গত বছরের নভেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। তাদের মধ্যে হাসিবুল ইসলাম শান্তকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করায় মুশফিক তাহমিদ তন্ময়কে ক্যাম্পাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই অভিযোগে বাকি তিনজনকেও সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সাময়িক বহিষ্কার ও মামলা চলমান থাকার পরও কয়েকজন দিব্যি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুধু তারাই নয়, প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবেই তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অনেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়েছেন। তবে যারা প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি হয়ে ধরা পড়েছেন, তাদের ভর্তি বাতিল করা হলেও নেওয়া হয়নি কোনো আইনি ব্যবস্থা। ফলে প্রতিবছরই রাবির ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে ঠেকানো যায় না এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট রাবি শাখার আহ্বায়ক ফুয়াদুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, অতীতে সামনে আসা সকল জালিয়াতিতে আমরা ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা দেখতে পেয়েছি। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের মাধ্যমে যে টিকে থাকার কায়দা- তারই ফলাফল ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দোকান বাকি এবং প্রক্সিকাণ্ডের মতোন নানান অপরাধ।

ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেছেন, গতবছর ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় ১৪ জনের নামে রেজিস্ট্রার বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলা এখনও বিচারাধীন। আমাদের ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখানে কোনোরকমের জালিয়াতি করার সুযোগ নেই। এবারও ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সার্বিকভাবে সচেষ্ট আছে। যেকোনো ধরণের জালিয়াতি ঠেকাতে ভর্তি পরীক্ষা কমিটি, পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা দফতরসহ সংশ্লিষ্টরা তৎপর থাকবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, আমাদের প্রতিটা নেতাকর্মীকে বলা আছে কেউ যদি জালিয়াতির সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ছাত্রত্ব বাতিলের সুপারিশ করা হবে। ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীদের সহায়তায় আমরা থাকবো। এজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী রাবি শাখার সভাপতি শাকিল হোসেন বলেন, বিগত সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটককৃত বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জড়িত থাকায় তাদের শাস্তি শিথিল করা হয়েছে। এজন্যই প্রতিবছর জালিয়াতির ঘটনা ঘটেই চলেছে।

জালিয়াতি প্রতিরোধের বিষয়ে রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, জালিয়াতি প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য দিক দিয়ে যতধরনের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব, তার সবই আমরা গ্রহণ করেছি। সকল
ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করছি।

জালিয়াতির ঘটনায় বারবার কেনো একই ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আমাদের কাছে জালিয়াতকারী হিসেবেই বিবেচ্য। সে যেই হোক। আমরা গতবারও জালিয়াতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের তাগাদা দিয়েছি, যাতে হবু জালিয়াতকারীরা ভয় পায়।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ