রুখবে কে? আতঙ্কে ১৮ দিনে রাজশাহীতে ৭১ টি রাসেলস ভাইপার হত্যা!

আপডেট: জুন ২৭, ২০২৪, ১২:২০ পূর্বাহ্ণ


মাহাবুল ইসলাম:


ছোট শিশুদের ভয় দেখিয়ে শান্ত করতে আবার কখনো ঘুম পাড়াতে গ্রামে-গঞ্জে দাদি-নানি-মায়েদের সাপ নিয়ে নানা কল্পকাহিনী বানানোর ঐতিহ্য বহু পুরোনো। সাপ নিয়ে সাপুড়ে ও কবিরাজের গাঁথা বিভ্রান্তি ও ভীতিকর গল্পগুলো এখনো গ্রামীণ অনেক মানুষ হৃদয়ে ধারণ করেন। একারণেই এখনো সর্প দংশনের পর গ্রামে-গঞ্জে প্রথম চিকিৎসা দেন কবিরাজ ও সাপুড়ে! এবার সে ঐতিহ্য ডিজিটাল মাধ্যম ফেসবুকের পাতায় ভাইরাল। দু’একটি ঘটনাকে পুঁজি করে অনেকেই ‘রং চড়িয়ে’ তা প্রকাশ করছেন।

এতে দেশব্যাপি এখন রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রাসেলস ভাইপার সাপসহ অন্য প্রজাতির সাপকেও! গত ১৮ দিনে পদ্মাতীরবর্তী রাজশাহী অঞ্চলের দুই জেলায় ৭১ টি রাসেলস ভাইপার সাপ হত্যার তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। যা জীববৈচিত্যের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায় গত ২৩ জুন বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সংলগ্ন পদ্মাপাড়ে বাচ্চাসহ ১৬টি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপকে হত্যা করা হয়েছে। গত ৭ জুন রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ৫৩ টি বাচ্চাসহ মা রাসেলস ভাইপার সাপকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া গত ২৪ জুন দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভোলাহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামে আম বাগানে একটি রাসেলস ভাইপারকে হত্যা করা হয়। এছাড়া প্রায়শই আতঙ্কিত হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সাপকে হত্যা করা হচ্ছে নির্বিচারে। যা আলোচনা ও গণমাধ্যমের পাতায় ঠাঁয় না পেলেও নিরবে নিভৃতে পরিবেশের ক্ষতি করছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাসেলস ভাইপার সাপ হত্যার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কেউ অতি উৎসাহী হয়ে আবার কেউ আতঙ্কিত হয়ে সাপগুলোতে হত্যা করেছে। সাপ হত্যার পর কেউ আবার বীরত্ব প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও দিয়েছেন। অথচ বাণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার সংরক্ষিত প্রজাতির সাপ। সাপ হত্যা দন্ডনীয় অপরাধ। তবে রাজশাহী অঞ্চলে সাপ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত এ আইনের বাস্তবায়ন হয় নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বড় প্রশ্ন সাপ হত্যা রুখবে কে?

গোদাগাড়ীর গাংগোবাড়ী প্রেট্রোল পাম্পের পাশে একটি ধানের খেত থেকে মাটি ট্রাকটারে নিয়ে আসা মাটি ফেলার পর রাসেল ভাইপারের মাসহ ৫৩ টি সাপ হত্যা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ছবি ও হত্যাকারীকে বাহবা দিয়ে পোস্ট দেয়া হয়। যেখানে কমেন্টেও সাপ হত্যাকে উৎসাহ দিয়ে মন্তব্য শেয়ার করেন মন্তব্যকারীরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ওই সাপ হত্যাকারীকে ‘সফল’ অ্যাখ্যা দিয়ে হত্যাকারী মো. মোহাম্মদ আলী নামের ওই ব্যক্তিকে বাহবা দেয়া হয়। পোস্টে সাপ থেকে রক্ষা পেতে সাপ দেখার সঙ্গে সঙ্গে হত্যার সুপারিশ করা হয়। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সাপ বিশেষজ্ঞরা।

গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ সাপগুলোকে রক্ষা করা জরুরি। আমরা সাপ ভীতি দূর করতে সচেতনামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের গামবুট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সাপ হত্যার কারণে কাউকে কখনো দণ্ড দেয়া হয় নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সাপের ভূমিকা অপরিসীম। বস্তুত সাপ প্রকৃতির বন্ধু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় অংশ। বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষস্থানীয় মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সাপ অন্যতম। প্রকৃতির অংশ হিসাবে সাপ মেরে ফেললে এর প্রভাব পড়বে পুরো বাস্তুচক্রে। ফসলি ক্ষেতে সাপ মারলে ইঁদুরের প্রভাব বাড়বে। সাধারণত প্রতি বছরই ১০ থেকে ২০ শতাংশ ফসল ইঁদুর নষ্ট করে। ফলে নির্বিচারে সাপ মারলে ইঁদুরের সংখ্যা বাড়বে। উৎপাদন কমে যাবে ফসলের।

সাপ ব্যাঙ, ইঁদুর খায়। বেজি, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল সাপ খায়। আবার শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে এই সাপগুলোও রাসেলস ভাইপারসহ অন্য সাপ খায়। ফসলী খেতে সাপ ইঁদুর খায়। তারা ইঁদুর খেয়ে ফসলের উপকার করে। এভাবে যদি প্রচুর পরিমাণ সাপ মারা হয় তবে এক শ্রেণির শিকারি প্রাণী কমে যাবে। কারণ তখন ভবিষ্যতে ইঁদুর বেড়ে যাবে। সেগুলো ফসল খেয়ে নষ্ট করে ফেলবে।

উৎপাদন কমে যাবে ফসলের। যেটা ফুড সাইকেলে প্রভাব ফেলবে। এভাবে সাপ মারলে ভবিষ্যতের জন্য অনেক ক্ষতি হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের এই প্রশিক্ষক বোরহান বিশ্বাস রোমন বলেন, সাপ মানুষের শত্রু নয়। সাপ মানুষের উপকারী বন্ধু। সাপ খুবই নিরিহ একটি প্রাণী। মানুষকে দংশন করে সাপ কখনোই তার নিজের বিষ নষ্ট করে দুর্বল হতে চাই না। তবে মানুষকে সাপ দংশন করে আতঙ্কিত হয়ে। আবার মানুষও সাপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে মারতে যায়। আমরা জন্মগতভাবে সাপ ভীতু। একারণে এই সমস্যাগুলো হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে সাপের দ্বন্দ্বটা থেকে যাচ্ছে।

যেটা কখনো প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমরা যদি সাপ মারতে থাকি, তাহলে অজান্তেই আমরা আমাদের বিপদ ডেকে আনবো। সাপ হত্যার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন খুবই জরুরি। আমাদের সকলের উচিত, সাপ সর্ম্পকে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা। মানুষ সচেতন হলেই সাপের সঙ্গে আর কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না। আর আইন থাকলেও সাপ হত্যার অপরাধে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির তৈরি হয় নি। সচেতনতার পাশাপাশি যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সাপ হত্যা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি।

বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ৮৫ ভাগের বেশি সাপেরই বিষ নেই। এমনকি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ বিষধর সাপের তালিকায় নয় নম্বরে রয়েছে। আর এখন আতঙ্কিত হয়ে মানুষ যেসব সাপগুলো মারছে তার বেশিরভাগই নির্বিষ ও পরিবেশের জন্য উপকারী। রাসেলস ভাইপার সাপের আতঙ্কে যেগুলো মারা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে শঙ্খিনী, অজগর, ঘরগিন্নি , দারাজ, ঢোঁড়াসাপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরাই রাসেলস ভাইপার সাপ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য আনে। অথচ এই উপকারী সাপগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানোয় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে না জেনেই মেরে ফেলছে প্রকৃতির বন্ধু নির্বিষ বিভিন্ন ধরনের সাপ ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। যে কোন সাপ দেখলেই মারা হচ্ছে।

দেশে রাসেলস ভাইপার সাপ চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া সাপ নামে পরিচিত। একসময় এই সাপটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ১০ – ১২ বছর আগে আবারো এই সাপের কামড়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে এই সাপটি বেশি দেখা যায় বলে জানান সাপ গবেষকরা। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী, রাসেলস ভাইপার সাপকে সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী রাসেলস ভাইপার সাপ মারা, ধরা এবং বহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এরই মধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সাপ না মারার আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রকাশ করেছে।

রাজশাহী বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, সাপ হত্যার ঘটনাগুলো দুঃখজনক। সাপ ও মানুষের সহাবস্থান তৈরি করার কোন বিকল্প নেই। প্রাণ-প্রকৃতির জন্য এটা অপরিহার্য। আমরা প্রতিনিয়তই মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আমাদেরও সীমাবন্ধতা আছে। সাধারণ মানুষও এ বিষয়টিতে সচেতন হতে চাই না নানা অজুহাতে। আর আইন প্রয়োগ করে মানুষকে সচেতন করা যাবে না। এ বিষয়ে সঠিক তথ্যসহ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণারও বিষয় আছে। তবে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা অতি উৎসাহী হয়ে সাপ হত্যা করলে আইনি ব্যবস্থা যেন নেয়া হয় সে বিষয়েও কাজ করা হবে।