সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে গ্রন্থিত ‘শরীফার গল্প’ প্রসঙ্গে কিছু কথা

আপডেট: জানুয়ারি ২৯, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

মুহম্মদ নূরুল্লাহ:

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের সম্প্রদায় অংশে গ্রন্থিত ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে। অভিযোগ- এই লেখায় শিক্ষার্থীদেরকে সমকামিতায় আগ্রহী করে তোলার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় চলছে- কেউ পক্ষে আর কেউ বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। এ বিষয়ে যাঁরা ভাবছেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরছি।

১. আলোচ্য ‘শরীফার গল্প’ অংশে শরীফা নিজেই নিজের কথা শিক্ষার্থীদের কাছে বলছে এবং নিজেকে তাদের সামনে ট্রানসজেন্ডার (transgender) হিসাবে বর্ণনা করছে। শরীফার বর্ণনায় ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে’। ট্রানসজেন্ডার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা নিজেকে প্রকৃতি প্রদত্ত লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মানুষ বলে ভাবতে পছন্দ করে। প্রকৃতি যাকে পুরুষ হিসেবে গড়ে দিয়েছে সে যদি নিজেকে নারী বলে মনে করে বা প্রকৃতি যাকে নিটোলভাবে নারী হিসাবে সৃষ্টি করেছে সে যদি নিজেকে পুরুষ মনে করে এবং পুরুষের জীবনাচার অনুসরণ করতে পছন্দ করে তবে সে ট্রানসজেন্ডার অর্থাৎ মানসিকভাবে নিজের লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে তার অবস্থান। সে কোনোমতেই তৃতীয় লিঙ্গ (intersex) বা তথা কথিত হিজড়া নয়। অর্থাৎ শরীফা একজন হিজড়া নয়।
ট্রানসজেন্ডারদের মানসিক চিকিৎসায় সারিয়ে তোলা যায় বা শল্য চিকিৎসা দ্বারা বিপরীত লিঙ্গে রূপান্তরিত করা যায়।

২. যারা শারীরিকভাবে সুস্পষ্ট লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ মুখ্য লিঙ্গবৈশিষ্ট্য (primary sex characteristics) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না বা যাদের বয়:সন্ধিকালে গৌণ লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্য (secondary sex characteristics) বিকশিত হয় না বা যাদের লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্বাভাবিক যৌন হরমোন নিঃসরণে ঘাটতি থাকে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে নারী বা পুরুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না, তারাই তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্গত বা হিজড়া। সুতরাং শরীফা হিজড়া নয়। শৈশবে যথাযথ শল্য চিকিৎসায় এ ধরনের শারীরিক গঠনগত ত্রুটি সারানো যায় বা বয়ঃসন্ধিকালে হরমোন থেরাপি দিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক করে তোলা যায়।

৩. ‘শরীফার গল্প’ রচনায় ট্রানসজেন্ডার আর হিজড়াকে (intersex) গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত: পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল হিজড়াদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সহানুভূতির মনোভাব সৃষ্টি করা। কিন্তু রচনাগত দুর্বলতার কারণে এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। গল্পে যে শরীফা আখতারকে (প্রকৃতপক্ষে শরীফ আহমদ) ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে হাজির করা হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষে নিখুঁত পুরুষ- মোটেই হিজড়া নয়, ট্রানসজেন্ডার। হিজড়াদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে একজন হিজড়াকেই চিত্রায়িত করতে হত। আলোচ্য বইটির পরবর্তী সংস্করণে একই শরীফাকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করে আর একটি বড় ভুল করা হয়েছে।
যারা পুরুষও নয় আবার নারীও নয় তারাই তৃতীয় লিঙ্গের। শরীফা পুরুষ। তার লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এরকম কোনো শরীফা আখতার যদি কোনো মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হতে চায় বা স্কুলের মেয়েদের হোস্টেলে থাকতে চায় তাহলে কি তাকে সেই অনুমতি দেওয়া উচিত? তার ভুল বিশ^াসকে গুরুত্ব দিয়ে তার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর সুযোগ কোথায়?

৪. সপ্তম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে এই জটিল ইস্যুটি নিয়ে আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই। দুই কারণে এই অংশটি তাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া উচিত- ক. এটি ত্রুটিপূর্ণ; খ. বয়সগত কারণে এটি সপ্তম শ্রেণির উপযোগী নয়। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে এটি সংশোধন করে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।

৫. ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। এতে সমকামিতার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির প্রচ্ছন্ন অভিভাবন (suggestion) খুব কষ্টকল্পিত। অভিযোগকারীরা এর মাধ্যমে জনমনে অশান্তি ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন এবং বয়ঃসন্ধিকালের ছাত্র-ছাত্রীদের এ ব্যাপারে কৌতূহলী করে তুলছেন। এ নিয়ে যারা সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় করছেন বা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করছেন তারা যদি প্রকৃতই এই ধারণা পোষণ করেন যে, এই রচনায় সমকামিতার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে তারা তা চিঠিপত্রের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে পারতেন। কিছু কিছু অভিযোগ থাকে যেগুলো সত্য হলেও প্রকাশ্যে করা অশোভন।

৬. ‘হিজড়া’ শব্দটি মোটেও শালীন নয়, এটি তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়। অথচ এখন এটি সরকারিভাবে এমন কি সরকারি উচ্চ পর্যায়েও নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আমার প্রস্তাব এর পরিবর্তে একটি বিকল্প শব্দ বাছাই করে নেওয়া দরকার যা মার্জিত এবং মানুষকে হেয় করে না। আমরা এখন বিকলাঙ্গকে শারীরিক প্রতিবন্ধী, হাবাকে মানসিক প্রতিবন্ধী, অন্ধকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কালাকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ইত্যাদি বলছি; তেমনি হয়তো হিজড়াকেও লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গ বলতে পারি। আর যদি লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার অস্বস্তিকর মনে হয় তাহলে হিজড়ার পরিবর্তে অনুদগত মানব (সংক্ষেপে অনুদগত), অপরিস্ফুট মানব (সংক্ষেপে অপরিস্ফুট বা অস্ফুট), অপরিণত মানব (সংক্ষেপে অপরিণত) বা অপরিপূর্ণ মানব (সংক্ষেপে অপরিপূর্ণ) ইত্যাদির মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে পারি। এ ব্যাপারে সরকার বিজ্ঞ ভাষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও শারীরশাস্ত্রবিদদের পরামর্শ নিতে পারেন।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী

Exit mobile version