হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে হলুদ মেশানো হয় II ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এমপি আনারকে হত্যায় পাঁচ কোটি টাকার চুক্তি

আপডেট: মে ২৩, ২০২৪, ১:৩৪ অপরাহ্ণ

সোনার দেশ ডেস্ক:


ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আর এই পরিকল্পনার মূল নায়ক তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়ী পার্টনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। তারই মূল পরিকল্পনায় হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমানকে। আমান তার সহযোগীদের নিয়ে কলকাতায় শাহীনের ভাড়া বাসায় হত্যা মিশন সফল করেন। এমপি আনারকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে তার মরদেহ অসংখ্য টুকরো করে ট্রলিব্যাগের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানিয়েছে ডিবি।
ডিবি সূত্র জানায়, এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি নেতা (পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি) আমানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ড সফল করতে শাহীন তাদের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকা চুক্তি করেন। কিলিং মিশন সফল করতে সেই টাকার একটি অংশও পরিশোধ করেছেন তিনি।

এর আগে, বুধবার (২২ মে) দুপুরে এমপি আজীমের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভারত জড়িত নয়। বাংলাদেশিরাই তাকে খুন করেছে। খুনের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ভারত অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করছে।

এরপর ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি।
কিলিং মিশনের পরিকল্পনা

তদন্তে জড়িত ডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে অনেক দিন ধরেই এমপি আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা ও পৌর মেয়রের ছোট ভাই।

গত ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান শাহীন কলকাতায় যান। তার সঙ্গে নেন চরমপন্থি নেতা আমান ও সিলিস্তা রহমান নামে এক বান্ধবীকে। এর আগেই কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট ভাড়া করেন তিনি। সেই ফ্লাটেই ওঠেন তারা। ওই ফ্লাটে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন শাহীনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

কিলিং মিশনের পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে গত ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলার ফয়সাল শাজী ও মোস্তাফিজকে গত ১১ মে নিয়ে যায় কলকাতায়।

কিলিং মিশন সমাপ্ত
আমানকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এমপি সাহেব ১২ মে কলকাতায় যাবেন চিকিৎসার জন্য। শাহীনও জানার পরই মূলত হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। সেই অনুযায়ী এমপি আনারকে হত্যার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন এবং ওই ফ্লাটে একাধিক চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখে তারা।
গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউ টাউনের ওই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা।

বিকেলের দিকে এমপি আনার সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে যান। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করে। এ সময় এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলে তারা। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর বিষয়টি শাহীনকে নিশ্চিত করেন আমান।

লাশ গুম করতে করা হয় অসংখ্য টুকরো
আমানের দেওয়া তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, শাহীনের পরামর্শ মতো লাশ গুম করতে এমপি আনারকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিং মল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। এরপর ঘটনার রাতে লাশের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগ বাসাতেই রাখা হয়। এরমধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে।

বুধবার কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখেছে, আমান ও তার সহযোগীরা মিলে ট্রলিব্যাগ আনা-নেওয়া করছে। এমপি আনারের বাইরে রাখা জুতা ভেতরে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এছাড়া বান্ধবী সিলিস্তা রহমান বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে হাঁটছে এটাও দেখা যায়।

গোয়েন্দাদের কাছে আমানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এমপি আনারকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে ১৪ মে বিকেলে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হন আমান। এরপর পাশের একটি শপিং মলের সামনে সেই ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যান। তবে সেই গাড়িচালককে কলকাতা পুলিশ আটকের পর জানতে পেরেছে, গাড়ি কিছু দূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে নেমে যান সিয়াম।

আমান জানান, লাশের টুকরোসহ আরেকটি ব্যাগ বাসাতেই ছিল। সেই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধও ছড়ানো শুরু করে। পরে লাশের ওই টুকরোসহ ব্যাগটি সহযোগীদের অন্য কোথাও ফেলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে সিলিস্তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আমান। আর আমানের দুই সহযোগী এমপি আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নিয়ে দুই দিকে চলে যায়, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমপি আনারের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়। এরপর ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল বাংলাদেশে ফেরত আসেন।

পাঁচ কোটি টাকায় চুক্তি
জিজ্ঞাসাবাদে আমান জানিয়েছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে কিছু টাকা পরিশোধ করেন। বাকি টাকা হত্যার পর দেওয়ার কথা ছিল। হত্যার পর লাশ গুমের দায়িত্ব দিয়ে আমান ঢাকায় এসে শাহীনের সঙ্গে সাক্ষাত করে। তবে শাহীন তাকে কত টাকা দিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি আমান। ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন আমান। সেখান থেকেই তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর আজীমকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলে গত ১৮ মে ভারত চলে যান শাহীন।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ভারত থেকে শাহীন নেপালে যান। গত ২১ মে নেপাল থেকে দুবাই যান এবং সবশেষ ২২ মে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তিনি।
গোয়েন্দা পুলিশর ধারণা, এমপি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে সোনা চোরাচালানের অর্থ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে। শাহীন নিজেও একজন সোনা চোরাচালানকারী। এমপি আজীমের বিরুদ্ধেও সোনা চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। কলকাতায় শাহীন ও আজিমের যৌথ ব্যবসা রয়েছে।

এ ঘটনায় ডিএমপির শেরেবাংলা নগর থানায় নিহত এমপি আজীমের মেয়ে ডরিন একটি হত্যা মামলা করেছেন। এমপি আজিম সংসদ ভবন এলাকায় থাকতেন এবং সেখান থেকেই ভারতে গিয়েছিলেন বলে এই থানায় মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক। এছাড়া কলকাতা পুলিশ বাদী হয়ে আরও একটি মামলা করেছে।

ডিবির রোমহর্ষক বর্ণনা, মরদেহে মেশানো হয় হলুদ
আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার গোয়েন্দাপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। হত্যার পর তার মরদেহ কীভাবে ফেলে দেওয়া হয়- গ্রেফতারদের বরাতে সে তথ্যও জানিয়েছেন ডিবিপ্রধান।

তিনি জানান, ভারতের কলকাতার নিউ টাউনের ওই বাসায় আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পর শরীর খণ্ড খণ্ড করা হয়। এরপর হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদের গুঁড়ো মিশিয়ে সেগুলো ব্যাগে ভরে বের করা হয় ওই বাসা থেকে। তবে কোথায় মরদেহের টুকরোগুলো ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। মরদেহের টুকরোগুলো খুঁজে বের করতে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ সব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই থেকে তিন মাস আগে। তারা পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি ও ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পরে সব হত্যার ক্লু পুলিশ বের করে ফেলবে বলেই হত্যাকারীরা কলকাতায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘অপরাধীরা বিদেশের মাটিতে অপরাধ করলে বাংলাদেশ পুলিশের নজরে আসবে না বলেই কলকাতা বেছে নেয়। বাংলাদেশের মাটিতে অপরাধ করার সাহস পায়নি। তবে তারা এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে থাকতে পারেনি। আমরা তিনজকে গ্রেফতার করেছি। আরও কয়েকজনকে নজরাদিতে রাখা হয়েছে।’

হারুন বলেন, ‘মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামানের এক বাসা গুলশানে, আরেকটি বসুন্ধরা এলাকায়। এই দুই বাসাতেই অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করেছে। আনারকে হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক যে কারণই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ এপ্রিল একটি বাসা ভাড়া নেয়। তারা ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠে। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনি ও আরেকজনসহ মোট তিনজন কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘তারা দুই মাস ধরে খেয়াল করছে, কখন আনারকে কলকাতায় আনা যাবে। সেখানে আরও দু’জনকে হায়ার করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা যাওয়া করবে। তারা হলেন, জিহাদ বা জাহিদ ও সিয়াম। মাস্টারমাইন্ড গাড়ি ঠিক করে। কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা হত্যায় থাকবে, কার দায়িত্ব কী হবে। কিছু কাজ আছে বলে ৫/৬ জন রেখে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন আখতারুজ্জামান শাহীন।’

এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ভিকটিমের মোবাইল নম্বর থেকে মেসেজ আদান-প্রদান করা হয়, যাতে করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে করে তদন্তে বেগ পায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিদেশের মাটিতে হত্যার কাজটি সংঘটিত করবে। হত্যার পর তার লাশ এমনভাবে গুম করে দেওয়া হবে যাতে করে কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। হত্যার পর তার শরীর বিভিন্ন অংশ বিভক্ত করা হয়েছে। হাড়-হাড্ডি থেকে শরীরের মাংস আলাদা করা হয়েছে। এরপর গ্রে কালারের লাগেজে ভরে মূল হত্যাকারী যিনি আমাদের কাছে আছেন তিনি ও জাহিদ ব্রিফকেস নিয়ে বের হয়। এরপর সিয়াম পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে আসেন আরেকজন, তিনি আমানুল্লাহ। ভারতীয় চালকসহ তারা গাড়ি নিয়ে চলে যায়।’

ডিবিপ্রধান বলতে থাকেন, ‘মূল যে হত্যাকারী তিনি বাসায় চলে যান। পরবর্তী সময়ে ২/৩ জন মিলে আনারের খণ্ড-বিখণ্ড শরীর কয়েকটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। তারা এমন নৃশংস কায়দায় হত্যার কাজটি সংঘটিত করেছে যাতে করে ধরা না পড়ে। সেজন্য তারা হাড়-গোড় মাংস আলাদা করেন, হলুদ মিশিয়ে দেন। যাতে করে কেউ বললেও বলতে পারে বাজার থেকে আনা। উদ্দেশ্য একটাই ছিল যে, কেউ যেন কোনো দিন আনারের অস্তিত্ব খুঁজে না পায়।’

তিনি জানান, ১৫ মে মূল হত্যাকারী, গার্লফ্রেন্ডসহ ফিরে আসে। ১৫ মে মোস্তাফিজ ফিরে আসে বাংলাদেশে। সবাই যখন ফিরে আসে তখন মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন ভিস্তারা এয়ারলাইনসে দিল্লি হয়ে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু চলে যান। সেখান থেকে হয়তো সে অন্য কোথায় চলে যেতে পারে।

তিনি আরও জানান, এই হত্যাকাণ্ডটা পরিকল্পিত। তারা দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজেই হত্যা করেছে। আমরা ১৮ মে’র পর তদন্ত শুরু করেছি, যখন গোপাল কলকাতায় সাধারণ ডায়েরি করেন। হত্যাকারীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন মেসেজ পাঠিয়ে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, তিনি জীবিত আছেন।’

তিনি আরও জানান, ম্যাসেজ এমন ছিল যে, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন। তার মন্ত্রী হওয়া নিয়ে কথা হবে।’ আসলে আনারের ডিভাইস ব্যবহার করে এসব মেসেজ দিয়েছে হত্যাকারীরা। তারা কখনো বেনাপোল, মুজাফফরাবাদ, কখনো পশ্চিমবঙ্গের শেষ বর্ডারে। সেখান থেকে তারা মেসেজ দিয়ে গেছে। তদন্তকারীরা যাতে ডিভাইসটা খুঁজে না পায় সেটিও তারা করেছে।’

হারুন বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। আমাদের কাছে আটক তিন জন স্বীকার করেছেন। আমাদের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ, কলকাতা সিআইডি এসটিএফ’র সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।’

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আজ ইন্ডিয়ান একটি তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিম আমাদের এখানে আসবেন। আমাদের হাতে আটক যে আসামি রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন, জিজ্ঞাসা করবেন। আমরাও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাব। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের মাটিতে তারা এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটাতে পারেনি।’

তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিন। শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলিস্তি রহমান। মূল হত্যাকারী বা সংঘটক তার নাম আমানুল্লাহ। তার আসল নাম কিন্তু আমানুল্লাহ না। তিনি মিথ্যে নামে পাসপোর্টটি করেছেন। তার আসল নাম শিমুল ভূইয়া। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে। আনার হত্যার ঘটনাটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।

মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি-না? জানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বলা সম্ভব না। তবে শিমুলের বর্ণনা মতে আসলে আনারের মরদেহ তো খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে। হাড়-হাড্ডি-মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা কাজ করছি। মামলা আগেই হতে পারে। কলকাতা পুলিশ তো নিশ্চিত হয়েছে হত্যা হয়েছে। যে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করেছে সে কলকাতা পুলিশের কাছে আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। কেন হত্যাকাণ্ড সেটি তো বের হবেই, তবে কারা কারা জড়িত, আরও কেউ জড়িত কি না, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা আশা করছি পুরোপুরি না পেলেও খণ্ডিত হলেও মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে।’

হারুন আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সব অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা। কী কারণে হত্যা সেটা পরে দেখব। ইন্ডিয়াতে যারা যারা সহযোগিতা করেছে তাদের সঙ্গে টাকা-পয়সার লেনদেন করেছে মূল মাস্টারমাইন্ড। আমাদের কাছে তিনজন আছে। কলকাতা পুলিশের কাছে আছে একজন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলছি না। তবে যে তিন জনকে আমরা ধরেছি তারা সবাই পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধের অভিযোগ। ওই আখতারুজ্জামান শাহিনের কথিত গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমানও আমাদের কাছে রয়েছেন।’

তদন্তে একসঙ্গে কাজ করবে দুদেশের পুলিশ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার রহস্য উন্মোচনে ভারতীয় গোয়েন্দা টিম বাংলাদেশের এসে কাজ করার বিষয়ে কথা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

প্রয়োজনে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা ভারতে যাবে কি না এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজন হলে যাবে। গোয়েন্দাদের কাজই তো এটা। তথ্যের জন্য গোয়েন্দারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন। ভারতের গোয়েন্দারাও আসতে পারে। হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে ভারতে। ভারতীয় গোয়েন্দারা কাজ করবেন। এ ঘটনায় আমাদের এখানে আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে একটা মামলা করেছে। সেই মামলার আলোকে আমরাও কাজ করবো। মামলা অনুযায়ী আমাদের ও ভারতীয় পুলিশ একত্রে কাজ করবে। অনেক কিছুই আমরা শুনছি। যখন কনফার্ম হবো তখনই জানাবো।বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আনারের ঘটনা তদন্ত করতে ভারতীয় টিম এখনো বাংলাদেশে আসেনি, কথাবার্তা চলছে। আমি তো আগেই বলেছি, ঘটনাটি ভারতে ঘটেছে। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, এ হত্যার পেছনে বাংলাদেশের মানুষ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে ভারতে। এ হত্যায় ভারত জড়িত কি না এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। দু’দেশের গোয়েন্দা পুলিশ মিলে যখন একমত হবে তখনই আমরা আপনাদের বিস্তারিত জানাতে পারবো। বিষয়টি নিয়ে তারা গুরুত্বসহকারে কাজ করছে।

তথ্য এসেছে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকায় এ হত্যাকাণ্ড। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমি তো বলেছি, আমাদের কাছে যখন সুনির্দিষ্ট তথ্য আসবে তখনই আপনাদের সবকিছু বলতে পারবো। আপনারা যেমন শুনেছেন, আমরা তেমন শুনছি। এসব কথা বলার জন্য আগে আমাদের তথ্য পেতে হবে। এখনো সম্পূর্ণ তথ্য আসেনি। সম্পূর্ণ তথ্য না এলে এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। তদন্তের আগে এসব বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই না। যেটুকু তথ্যে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে না সেটুকুই আপনাদের বলেছি।

এ হত্যাকাণ্ডে ভারতের কেউ জড়িত কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা তো কোনো কিছুই উড়িয়ে দিইনি। আমরা তো বলছি, তদন্ত চলছে। আমিতো এখনো বলিনি কারা কারা জড়িত। তবে আমরা একটা সম্যক ধারণা পেয়েছি। আমরা সেই ধারণার ওপর কাজ করছি।

আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য এসেছে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমরা যেটুকু শুনেছি- ভারতের একটি ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় পুলিশ আমাদের এগুলো জানিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা গুরুত্বসহকারে এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত, হত্যাকাণ্ডের কারণটা কি এসব কিছুই আপনাদের বলবো।

কলকাতা পুলিশের দুই সদস্য ঢাকায়

আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা তদন্তে কলকাতা পুলিশের দুই সদস্য এখন ঢাকায় এসেছেন। তাঁরা ডিএমপি সদর দপ্তরে অবস্থান করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল আহাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কলকাতা পুলিশের দুই সদস্য ডিবি কার্যালয়ে এসে গ্রেফতার তিন আসামির সঙ্গে কথা বলবেন। তদন্তকারী সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে তিন সদস্যের পুলিশের একটি দল কলকাতায় ঘটনাস্থলে যাবেন।

৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ

ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনারকে খুনের উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় ৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) মামলার এজাহার আদালতে আসে। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহবুবুল হকের আদালত তা গ্রহণ করেন। আগামী ৪ জুলাই প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
শেরেবাংলা নগর থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার সাব-ইন্সপেক্টর জালাল উদ্দিন এ তথ্য জানান।

এর আগে, বুধবার সন্ধ্যায় আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করেন। মামলায় মুনতারিন ফেরদৌস ডরিন উল্লেখ করেছেন, মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বাসায় আমরা সপরিবারে বসবাস করি। ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা আনোয়ারুল আজিম আনার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১১ মে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বললে কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাই।

ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি অভিযুক্ত শাহীনের
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের ঘটনায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহীন। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে শাহীন জানান, আনার হত্যার সময় তিনি বাংলাদেশে ছিলেন না। অস্বীকার করেন, ৫ কোটি টাকায় কিলিং মিশন চুক্তির খবর।
আক্তারুজ্জামান শাহীন বলেন, এই ঘটনায় আমাকে ফাঁসানো হয়ে। এই ঘটনার সময় আমি ভারতে ছিলাম না। আমার আইনজীবী বলেছে এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা না বলতে। মানুষ দেশে অনেক কথাই বলে। যদি কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে দেখাক।

ফ্লাটের ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যদি ফ্লাট ভাড়া নেই। আমি কি আমার ফ্লাটে এই ধরনের কাজ করব? আমার পাসপোর্ট রেকর্ড দেখলে দেখা যাবে আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখন বলা হচ্ছে আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি। কিভাবে আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি। কোথা থেকে পেলাম আমি এত টাকা। এখন এগুলো মানুষ বললে আমার কি করার আছে। ঘটনা কবে ঘটেছে সেগুলো আমি পত্রিকায় দেখেছি। সে সময় আমি বাংলাদেশে ছিলাম না।