২০ বছরেও চরখানপুরে হয়নি চিকিৎসা কেন্দ্র II নাজুক অবস্থায় চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থার

আপডেট: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


নদী ভাঙ্গনে চর বিলীনের ২০ বছরেও চরখানপুরে হয়নি কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র। ফলে চিকিৎসা সেবার নাজুক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছেন চরবাসী। রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটির মানুষ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তবে দুইজন গ্রাম্য চিকিৎসকের সেবায় জ্বর, সর্দি-কাশি সারলেও অন্য অসুখের চিকিৎসা নিতে গ্রামবাসীকে আসতে হয় শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।

জানা গেছে, চরখানপুরের জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস। বসত ঘর আছে ৮৫০টির মতো। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই উচ্চ বিদ্যালয়। তবে চারটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে। গ্রামে দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৭ বছরের বেশি সময় ছিল না হাট। তবে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) থেকে গ্রামের স্কুল মাঠে বসছে হাট। তা গ্রামবাসী খুশি। ২০০৪ সালে চরখানপুরে স্বাস্থ্য সেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। কিন্তু নদীভাঙ্গনে পদ্মায় চরখানপুর বিলীনের পরে আর স্বাস্থ্যসেবার সেইভাবে ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। প্রায় সাড়ে আট শতাধিক পরিবার অধ্যুষিত গ্রামে কোনো রাস্তাঘাট নেই। গ্রামটিতে যাওয়া আশার একমাত্র বাহন নৌকা।

চরখানপুর থেকে রাজশাহী শহরে যেতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে সৌরবিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা রয়েছে। পদ্মা নদীকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করেন গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ। তবে পদ্মা নদীই তাদের বড় দুঃখ। নদীভাঙনের ফলে বারবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের আবাসস্থল, সহায়সম্পদ। তাই কিছুদিন পরপরই তাদের পরিবর্তন করতে হচ্ছে বাসস্থান। একসময় এ গ্রামে তিন হাজারের বেশি পরিবার থাকলেও এখন কমে গেছে জনবসতি। যদিও বর্তমানে কৃষি ও পশু পালন তাদের জীবিকার মূল উৎস। চরের জমিতে ধান চাষ ও পশু পালন ছাড়াও নদীতে মাছ শিকার ও নৌকা চালিয়ে চলে তাদের সংসার।

এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সাবান আলী জানান, চরখানপুর গ্রামটি চরখিদিরপুর মৌজায় অবস্থিত। কিন্তু নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় খিদিরপুর এলাকার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। এই গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকার মূল উৎস কৃষি কাজ ও পশু পালন। অনেকেই মাছ শিকার করেন। এই গ্রামে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) থেকে হাট বসছে। যা আগে ছিল না। তবে কিছু দোকান রয়েছে- যে দোকানগুলো রাজশাহী শহর থেকে কেনা মালামালে চলে।

তিনি বলেন, গ্রামে স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা একইবারে নাজুক। এখানে দু’জন গ্রাম্যচিকিৎসক বসবাস করেন। যারা জ্বর, কাশির চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বেশি অসুস্থ (গুরুত্বর) কিছু হলে নিতে হয় রাজশাহী শহরের হাসপাতালে। আর সন্তান সম্ভাবা নারীদের আগে থেকেই শহরে কোনো অত্মীয়ের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অনেকের রাজশাহী শহরের আশেপাশে আত্মীয়ের বাড়ি রয়েছে। যাদের নেই তারা প্রসব বেদনা উঠামাত্রই দ্রুত ঠেলাগাড়ি দিয়ে নদীর ঘাট, ঘাট থেকে নৌকায় নদী পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিতে হয়।

এই এলাকায় নানা বাড়ি আকাশ আলীর। তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে বেড়াতে এসেছেন চরখানপুরে। তিনি বলেন, এই চরের ছেলে-মেয়েরা শহরের স্কুলে-কলেজে পড়ালেখা করে। সেই জায়গা থেকে শিক্ষায় নারীরা অনেক পিছিয়ে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণে চরের ছেলে-মেয়েদের যেতে হয় রাজশাহী শহরে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের ৪৫ বছরের এক নারী বলেন, আগে তো মানুষের অসুখ কম ছিল। এখন মানুষের শরীরে নানা অসুখ বাসা বেধেছে। এখানে সকারিভাবে কোনো চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেই। অনেকেই সন্তান প্রসব করে বাসাবাড়িতে। বেশি অসুস্থ হলে রাজশাহী শহরের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখানে সরকারিভাবে সপ্তায় দু’দিন হলেও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা দরকার।

গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক পারভেজ সাজ্জাদ জানান, তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তিনি শহর থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। এরপরে তিনি বিক্রি করে থাকেন। জ্বর, কাশি, গ্যাসের ওষুধ বিক্রি করে থাকেন তিনি। তার দাবি-গ্রামে রাস্তাঘাট না থাকায় বর্ষাকালে চিকিৎসাসেবা খুব ব্যাহত হয়।

এ বিষয়ে পবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাবেয়া বসরী বলেন, এই চরে বিভিন্ন ভ্যক্সিনেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাদের কর্মীরা সেখানে যান চিকিৎসা সেবা দিতে। এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। বিষয়টি আমরা ঢাকায় জানিয়েছি।

এ বিষয়ে পবা হরিয়ান ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আবু জাফর ইবনে আলম বলেন, মৌলিক চাহিদার দুইটি অনুপস্থিত এই চরখানপুরে। এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা একইবারে নাজুক। নদীভাঙ্গনে আগে চরখানপুরে ২০০৪ সালের দিকে কমিউনিটি ক্লিনিক ছিল। ২০ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবার কোনো ব্যবস্থা নেই।

তিনি বলেন, এই আসনের সংসদ সদস্যকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তিনি ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন। দেখা যাক কি হয়। ২০ বছরেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এই এলাকায় দু’জন গ্রাম্য চিকিৎসক রয়েছেন। তারা জ্বর, কাশির ওষুধ দেন। এছাড়া অন্য চিকিৎসার জন্য আমাদের চরবাসীকে রাজশাহী শহরে যেতে হয়। বিশেষ করে প্রসুতি মা’দের বেশি সমস্যা হয়। অনেক সময় সন্তান প্রসবের সময় শিশু মারা যাওয়ার নজিরও রয়েছে।