এক ইমামের ব্যতিক্রমি বিদায় সংবর্ধনা

আপডেট: নভেম্বর ১৮, ২০২৩, ৭:৩৮ অপরাহ্ণ


পাবনা প্রতিনিধি :


‘যেতে নাহি দিব হায়/ তবু যেতে দিতে হয়/ তবু চলে যায়।’Ñ কবির এই অমোঘ বাণীরই যেন প্রতিফলন হলো বর্ষীয়ান এক ইমামের বিদায় অনুষ্ঠানে।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) বেলা পৌনে ১১ টা। বাড়ইপাড়া বাজার মোড়ে পৌঁছেই দেখা গেল জমকালো আয়োজন। নিরেট গাঁও গেরামের মানুষজন রঙ-বেরঙের জামা-কাপড় পরে ঘোরাফেরা করছেন। জালি-বুড়ো সবারই যেন পরিপাটি পোশাকে মসজিদের আশপাশে আনাগোনা। পাশেই বাজারের একটা ঘর থেকে ভেসে আসছে গরম জিলাপির মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ইপাড়া গ্রামের লোকজন বেশ উৎসব আমেজে। উপলক্ষ একটাই, তা হলো- বাড়ইপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমামকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হবে।

পাবনার সুজানগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল বাড়ইপাড়া। মাত্র কয়েক বছর আগেও সেখানকার রাস্তায় যেতে বেশ বেগ পেতে হতো। বাংলাদেশের সব জেলায় যেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, তেমনি বাদ পড়েনি বাড়ইপাড়া গ্রামও। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তারা শহরের মানুষকেও যেন টেক্কা দিতে চলেছেন। এমনই জানালেন বাড়ইপাড়া মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য মো. মনসুর উদ্দিন। তিনি জানান, তাদের মসজিদ কমিটিতে ১১ জন সদস্য আছেন যারা মাস্টার্স পাশ করা। আছেন একজন এসপিও।

চারিদিকে পাকা সোনালী ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। কারো কারো খেত থেকে ধান কেটে মাড়াইয়ে ব্যস্ত কিষাণ-কিষাণীরা। মূলত পেঁয়াজের জন্য বিখ্যাত এলাকাটি। কেউ ধান কেটে পেঁয়াজের থেত তৈরিতে ব্যস্ত। ধান-পেঁয়াজে সমৃদ্ধ এলাকাটির বড় মসজিদ হচ্ছে বাড়ইপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ।

বেলা ১১ টার দিকে প্রথম মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি মো. হাবিবুর রহমান বিশ্বাস মসজিদের মাইকে ঘোষণা করলেন ‘আজ ইমাম সাহেবের বিদায় অনুষ্ঠান হবে…। আপনারা সবাই মসজিদে চলে আসুন। কাজকর্ম ফেলে সবাই মসজিদে আসুন।’ চারদিক থেকে শিশু -কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সবাই রওনা মসজিদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে যেন তিল ধারণের জায়গা নেই।

হাফেজ আলহাজ্ব আবুল কাশেম দীর্ঘ ৬০ বছর ইমামতি করেছেন। মাঝখানে ৭ বছর মালিফা মাদ্রসায় ছিলেন। আরও কিছুদিন অন্য প্রতিষ্ঠানে, তারপর এখানেই স্থির হয়ে যান। এখানকার স্বল্প বেতনে খেয়ে- পরে চার ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের অবস্থা মোটামুটি ভাল। আজ ৮২ বছর বয়সে গায়ে গতরে শক্ত সামর্থ্য থাকলেও বাম হাতের ব্যথায় বড়ই কাতর তিনি। এটা টের পাওয়া গেল মসজিদে বৈদ্যুতিক পাখা চালু হবার পর। তিনি বললেন, ফ্যান দিওনা বাবা! ফ্যান চললে আমার হাতের জয়েন্টের ব্যথা বেড়ে যায়।

বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতায় প্রথমেই কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি উপস্থিত জ্যেষ্ঠ মুসল্লিদের নিয়ে ইমাম হাফেজ আবুল কাশেমকে নতুন পোশাক পরিয়ে দেন। এরপর ফুলের তোড়া, ক্রেস্ট দিয়ে তাকে সম্মানিত করা হয়। সাথে এক লক্ষ টাকাও দেয়া হয় হাদিয়া হিসেবে। ইমাম যেন আনন্দে আত্মহারা। জীবনে কোনো দিন এতো সম্মান পাননি। আশাও করেন নি। আজ তার জন্য এতোসব আয়োজন ! যেন তার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে এসব!

এরপর মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. মনসুর উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি মো. হাবিবুর রহমান বিশ্বাসের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় আবেগময় আলোচনা সভা। আলোচনায় সবাই ইমামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আবেগঘন আলোচনায় অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন অনেক মুসল্লি। বক্তারা আবেগজড়িত কন্ঠে বলেন, এই মসজিদটি ছিল একটি ভাঙা মসজিদ। ইমাম সাহেব যেখানেই গিয়েছেন সেখান থেকেই আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এসেছেন মসজিদটি টিকিয়ে রাখতে। এমনি ভাবেই বহুদিনের চেষ্টায় সর্বোপরি বর্তমান কমিটির সর্বোচ্চ চেষ্টায় বাড়ইপাড়া মসজিদটি আজ উল্লেখযোগ্য একটি মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

মসজিদ কমিটির সভাপতি মনসুর উদ্দিন বলেন, হাফেজ আবুল কাশেম একজন ভাল মানুষ। মসজিদের প্রতি তার অনেক ভালবাসা, অনেক দরদ। তিনি বিদায়ী ইমামের বাকি দিনগুলি সুস্থ-সুন্দর ভাবে পার হোক এই কামনা করেন।

মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি মো. হাবিবুর রহমান বিশ্বাস বলেন, একদিন মসজিদে নামাজিদের ইমাম সাহেব আকুতি জানিয়ে বলেন, আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গার মসজিদে নামাজ পড়াতে গিয়ে দেখি তাদের মসজিদটি কত সুন্দর। আমরা কতকাল আর এই জীর্ণশীর্ণ মসজিদে নামাজ পড়বো? আপনারা কি উদ্যোগ নিতে পারেন না মসজিদটিকে সুন্দর করে তৈরি করতে? তখন থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই মসজিদটিকে আধুনিক করে গড়া তোলার জন্য। তিনি বলেন, এই এলাকার সব মানুষের সহযোগিতা ও বাইরের কিছু মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় বাড়ইপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদটি আজ উন্নতমানের টাইলস সহ আধুনিক, সুন্দর মসজিদে পরিণত হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন, মসজিদে ফ্যান দরকার, একদিন ইমাম সাহেব নামাজের সময় বললেন, নাম ধরে ধরে বললেন অনেককে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, ৪০-৪২ ফ্যানের ব্যবস্থা হয়ে গেল। অন্য বক্তারা বলেন, হাফেজ আবুল কাশেম ইমাম হিসেবে আমাদের এতোদিন যে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন, যে শিক্ষা দিয়েছেন তা ভালভাবে জীবনে মেনে চলতে পারলেই তাকে যথাযথ সম্মান দেয়া হবে। এ সময় বক্তব্য দেন, মসজিদ কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ুম মোল্লা, মসজিদ কমিটির সহসভাপতি ও সাতবাড়িয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন, ক্যাশিয়ার মো. শাহাদত হোসেন, ইউপি সদস্য মো. ইমরান হোসেন, সদস্য আব্দুল্লাহ মোমিন, বদর উদ্দিন শেখ, হারুনার রশিদ বাচ্চু, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

বিদায়ী ইমাম হাফেজ আবুল কাশেম তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি বাড়ইপাড়া মাদ্রাসা থেকে নোয়াখালীর হুজুর নেসারুল হক সাহেবের কাছ থেকে ৩০ পাড়া হাফেজি পড়া শেষ করে প্রথম এই মসজিদে ইমামতি শুরু করি। আমার ইমামতির বয়স প্রায় ৬০ বছর। এই মসজিদে যখন ইমামতি শুরু করি তখন আমি ১৮/২০ বছরের টগবগে যুবক। এখন আমার বয়স ৮২ বছর। তিনি বলেন, আমার মনের বড় সাধ, মনের বড়ই ইচ্ছা মসজিদটিকে দোতলা দেখে যাওয়ার। কিন্তু তা কি আর পারবো? তিনি আবেগজড়িত কন্ঠে বলেন, গ্রামবাসী তো এই মসজিদ থেকে আমাকে যেতে দিতে চায় না।অ কিন্তু বার্ধক্য যে ভর করেছে, আমাকে তো বিদায় নিতেই হবে।

১৭ই নভেম্বর শুক্রবার বিদায়ী দিনে শেষ জুমআ’র নামাজ পড়ান তিনি। এ সময় অশ্রুসজল নয়নে তাকে খুবই আবেগ তাড়িত মনে হচ্ছিল। সবাইকে তিনি বার বার শেষ মোনাজাতে অংশগ্রহণ করে যাওয়ার অনুরোধ করছিলেন। অর্ধশত বছরের ইমামতি ছেড়ে মুসল্লিদের বিদায় জানাতে যেন তার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। বার বার গলা জড়িয়ে আসছিল, কিন্তু তিনি আবেগ চেপে রেখে ধৈর্য্যরে সাথে সবার সাথে কথা বলেন। তার চোখ ছল ছল অবস্থা দেখেছেন অনেকেই ব্যথিত হয়েছেন, অনেকেই চোখের কোণায় জমা অশ্রুবিন্দু নিরবে মুছেছেন।

জুমার নামাজ শেষে শশ্রুমণ্ডিত, বয়োবৃদ্ধ ইমামকে সাদরে ধরাধরি করে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে এলাকার বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করান কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি। এসময় আনন্দে অনেকেই নানান স্লোগান দিতে থাকেন। এলাকার রাস্তাঘাটের দূরবস্থার কারণে সব এলাকায় ঘোরাতে পারলেন না তাকে। এ আক্ষেপ গ্রামের লোকজনের। তারা জানায় বার বার এমপি কথা দিলেও আমাদের বাড়ইপাড়া গ্রামের রাস্তার উন্নয়ন হচ্ছে না।
এত সীমাবদ্ধতার পরেও এমন ব্যতিক্রমি ও জমকালো আয়োজনে বিদায় জানাতে পেরে ভীষণ খুশি গ্রামবাসী।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ