নাটোরে ঠেকানো যাচ্ছে না আবাদি জমিতে পুকুর খনন!

আপডেট: এপ্রিল ৪, ২০২৪, ৯:২০ অপরাহ্ণ

পুকুর খননের সময় এক্সকেভেটর পুড়ালো দুর্বৃত্তরা

নাটোর প্রতিনিধি:নাটোরে কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না আবাদি জমিতে পুকুর খনন। কৃষি জমি রক্ষায় উচ্চ-আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তা মানা হচ্ছে না। তিন ফসলি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খনন বন্ধ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়ে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা প্রতিবাদ করছেন। তাতে প্রতিকার না পেয়ে এক্সকেভেটর মেশিন পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। নাটোর সদরসহ ৭টি উপজেলায় এখন মহোৎসব চলছে চলছে পুকুর খনন।

এদিকে নাটোর সদর উপজেলার পাইকোরদল এলাকায় অবৈধভাবে পুকুর খননের সময় কে বা কারা আগুন দিয়ে এক্সকেভেটর মেশিন পুড়িয়ে দিয়েছে। পরে ফায়ার সার্ভিস একঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বুধবার (৩ এপ্রিল) রাত ১০.৩০ টার দিকে কয়েকটি মোটর-সাইকেলে আসা কতিপয় যুবক পুকুরে থাকা এক্সকেভেটর মেশিনে অগুন লাগিয়ে দেয়।

নাটোরে সরেজমিনে দেখা যায়, নাটোর সদর উপজেলার কোরটা, গাজীরবিল, লক্ষীপুর-খোলাবাড়িয়া, ভাতুরিয়া, ছাতনী, বাকশোর, পাইকোরদৌল, বলদখাল সহ বিভিন্ন গ্রামে ফসলি জমিতে চলছে পুকুর খনন। বিলের চতুর্পার্শ্বে তাকালেই দেখা যায় বিগত দিনে গড়ে ওঠা পুকুর আর পুকুরের পাশে পতিত হয়ে গেছে অনেকের আবাদি জমি। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। চার ফসলি জমি নিয়ে বিপাকে পড়েছে ওই এলাকার অনেক কৃষক। এরই মধ্যে নতুন করে আবার খনন হচ্ছে চার ফসলি জমিতে পুকুর। এমন চিত্র শুধু নাটোর সদর নয়, সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর-বাগাতিপাড়া এবং নলডাঙ্গা উপজেলাতেও।

স্থানীয়রা জানান, নাটোর সদর পাইকোদল উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একরামুল ইসলাম তার জমিতে ৮-১০ দিন ধরে প্রতিরাতে পুকুর খনন করছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন রাতে মাটি কাটার মেশিনে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
নাটোর ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার শাহাদত জানান, প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

নাটোর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু রায়হান বলেন, ‘অবৈধভাবে পুকুর খনন করার সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই দুর্বৃত্তরা এক্সকেভেটর মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে কাউকে পায়নি। পরে ফায়ারসার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আর ঘটনার তদন্ত চলছে।

অপরদিকে ৩টি ফসলি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খনন বন্ধ ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে নাটোরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন কৃষক এবং ভূমি সুরক্ষা কমিটি। বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) বিকেলে সদর উপজেলার ভেদরার-বিল এলাকায় স্থানীয় কৃষকরা এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।

ইট ভাটা মালিকরা বলছেন, ইট ভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। সরকারকে রীতিমতো ভ্যাট ট্যাক্স প্রদান করা হয়। এমতাবস্থায় মাটির সঙ্কটে পড়ি আমরা। যদি সঠিক ভাবে মাটি না পাই তবে ভাটা বন্ধ করে দিতে হবে। ভাটা যদি বন্ধ হয় তাহলে ইটের দাম বৃদ্ধি পাবে। আর আমাদের যেহেতু বৈধ রেজিস্ট্রেশন আছে সেই সুবাদে সরকারিভাবে আমাদেরকে মাটি দেয়া উচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ইট ভাটা মালিক জানান, কোথায় কোথায় পুকুর খনন হচ্ছে তা প্রশাসনের কাছে তালিকা দেয়া আছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, নাটোর জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে প্রায় ২৬৩টি। তার মধ্যে শতাধিক ইট ভাটার নেই বৈধ কাগজপত্র।

নাটোরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ‘২০১০-১১ মৌসুমে নাটোর জেলায় মোট আবাদি জমি ছিল এক লাখ ৫০ হাজার ৮৩৮ হেক্টর। এ বছর তা কমে এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৭ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৬হাজার হেক্টোর কৃষি জমি কমেছে।

এসব আবাদি জমির বেশির ভাগই পুকুর খনন করা হয় ও খননকৃত পুকুরের মাটি পুড়িয়ে ভাটায় ইট তৈরি করা হয়েছে।’
সাময়িক বেশি লাভের আশায় কৃষকরা ফসল উৎপাদন না করে মাছ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কিন্তু, যেসব জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে তা আর কখনোই আবাদি জমিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কেননা, মাটিগুলো পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে।

নাটোর জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, ‘তিন-চার ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এক ফসলি বা অনাবাদি জমিতে পুকুর করে মাছ চাষের বিষয়ে কৃষকদের সচেতন ও ৩-৪ টি ফসলি জমিতে পুকুর খননে নিবৃত করতে চাষিদের পরামর্শ দেন মৎস্য বিভাগ।

২০১৯ সালে ঢাকার ল’ ইয়ারস সোসাইটি ফর ল’ নামের মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে এর মহাসচিব মেজবাহুল ইসলাম আতিক নাটোরের পাঁচ উপজেলা— নাটোর সদর, নলডাঙ্গা, সিংড়া, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুরে আবাদি জমিতে জনগনের স্বার্থে পুকুর খনন বন্ধ করার আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেছিলেন।

শুনানি শেষে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মাদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই বছরের ১২ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, নাটোরের জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট পাঁচটি উপজেলায় কৃষি জমিতে অবৈধ পুকুর খনন বন্ধ করতে তদারকি এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়। তবু বন্ধ হয়নি আবাদি জমিতে পুকুর খনন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুইঞা জানান, জেলার প্রতিটা ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা আবাদি জমি রক্ষায় মোইল কোর্ট পরিচালা করে পুকুর খনন বন্ধন এবং আর্থিক দন্ডসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।