শ্রমিকদের নিরাপত্তায় উদাসীনতা সবখানে

আপডেট: মে ১, ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


ঝুঁকিমুক্তের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন কাগজে-কলমে থাকলেও এখনও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা এসব শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে উদাসীনতা পরতে পরতে। শুধু নিরাপত্তাই নয়, রয়েছে মজুরি বৈষম্যও। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে কাজ করছেন নারীরা। কিন্তু বেতন ও মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা।

জানা গেছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক সচেতনতামূলক নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ভবন নির্মাণে চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হবে। উঁচুস্থানে কাজের ক্ষেত্রে লিফট, সেফটি বেল্ট, শক্ত দড়ি-মাচা (কোমরে) ব্যবহার; একই সাথে কাজের সময় মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের তারের কাছে রড ওঠানো-নামানো থেকে বিরত থাকাতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে এই সমস্ত সামগ্রী ছাড়াই কাজ করতে গিয়ে ঘটে ছোট বড় দুর্ঘটনা।

সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সুউচ্চ ভবন তৈরিতে কাজ করছেন নারী ও পুরুষেরা। কিন্তু ভবনগুলোতে কোন ধারনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই শ্রমিকদের জন্য। তবে বেশিরভাগ ভবনের চারপাশে কোন ধারণের নিরাপত্তাবেষ্টনীর ব্যবস্থা নেই। ফলে শুধু শ্রমিকই নয়, ভবনের পাশ দিয়ে চলাচলে উপর থেকে নির্মাণ সামগ্রী মাথায় পড়া নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি থেকেই যায়। এছাড়া বিভিন্ন নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করেন শ্রমিকরা।

কুমারপাড়ার মোড়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয়-সাব ঠিকাদর শাহিদ ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো ব্যবহার করা হয়। তবে খুব কম। অনেক নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রমিক ব্যবহার কারতে অনিহা প্রকাশ করেন। তবে তারা চেষ্টা করেন সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিতের।

নির্মাণ শ্রমিকদের মিস্ত্রি মতিন বলেন, নিরাপত্তায় কাজে লাগবে। এই সব জিনিস সাইট থেকে তেমন পাওয়া যায়না। কোন কোন সাইটে থাকে। তবে শ্রমিকরা ঠিক মতো ব্যবহার করতে পাই না। এসব কারণে অনেক সময় ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

শুধু নিরাপত্তায় নয়, ছেলেদের চেয়ে নারী শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি বৈষম্য দীর্ঘদিনের। একই কাজ করে পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকদের কম মজুরি পায়।
নারী শ্রমিকরা জানায়, কর্মক্ষেত্রে মজুরির বৈষম্য জেনেও তাদের জীবিকার তাগিতে কাজ করতে আসতে হয়। তবে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও মাঝে মাঝে সহকর্মীদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়। একসময় নারী বলে কাজে নিতেও আপত্তি উঠত। এখন তেমন উঠে না। তবে কাজের ধরন, সময় অনুসারে মুজরি নির্ধারণ করা হলেও নারীরা পুরুষ শ্রমিকের থেকে কম মজুরি পান। পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৫০০-৮০০ টাকা মজুরি পেলেও নারী শ্রমিক পান ৪৫০-৫০০ টাকা।

সাব ঠিকাদার শাহিদ ইসলাম বলেন, কাজের রেট তেমন বাড়েনি। তাবে নির্মাণ সামগ্রী এবং শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। ৫ বছর আগে ২০০ থেকে ১৯০ টাকা ছাদ মাপের রেট (স্কয়ার ফিট)। কিন্তু সবকিছু দাম বাড়লেও এখন ওই রেটে কাজ চলছে। তার পরেও বছরের এই সময়ে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দেয়। কারণ শ্রমিকরা জেলা বিভিন্ন উপজেলায় ধান কাটার কাজ করেন। তাই শ্রমিকরা পাওয়া যায়না।

নারী-পুরুষের বেতনের বিষয়ে তিনি বলেন, পুরুষ শ্রমিকের বেতন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আর মিস্ত্রিদের বেতন বেশি। নারী শ্রমিকদের বেতন ৬০০ টাকা। তার মধ্যে সদরাররা কিছু টাকা নেয়। নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে সরদার টাকা নেই। যদি নারী শ্রমিকের বেতন ৫০০ টাকা হয়। তাহলে তারা সরদাররা সাড়ে ৪০০ টাকা দেয়। ৫০ টাকা কেটে নেয় গাড়ি ভাড়া হিসেবে।

শ্রমিক সরদার অতিক হাসান বলেন, গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট থেকে গাড়িতে করে শ্রমিক নিয়ে রাজশাহীতে এসে কাজ করাচ্ছি। নারীদের বেতন ৫০০ টাকা। কিন্তু গাড়ি ভাড়া হিসেবে ৫০ টাকা করে নেয়। শ্রমিকরা পরে চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য ২০-৩০ টাকা করে দেয়।

নির্মাণ শ্রমিক রুপালি মার্ডি বলেন, তারা কাঁকানহাটে কাদিপুর থেকে এসেছেন। প্রতিদিন কাজের মজুরি হিসেবে ৫০০ রোজ পান তারা৷দুই বছর ধরে এই কাজ করছেন তিনি। তার স্বামী রয়েস হেমরম এলাকায় কৃষি কাজ করেন।

পুরুষের তুলনায় আপনারা (নারী) কম মজুরি পান এই কথার উত্তরে তিনি বলেন, সব জায়গায় নির্মাণ কাজে নারীরা কম বেতন পান। কিছু বলার নেই তাদের।
নির্মাণ শ্রমিক সোনালী হেরম বলেন, তার স্বামী বিশ্বনাথ মুরমু কৃষি কাজ করেন। স্বামীর পাশা-পাশি পরিবারে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য কাজ করেন তিনি। একই কাজে পুরুষের তুলনায় বেতন কমের বিষয়ে তিনি বলেন, কাজের সরদারা পুরুষের তুলনায় তাদের (নারী) কম মজুরি দেন। তাদের ধারণা নারী শ্রমিকদের হয়তো কম কাজ করে, তাই। কিন্তু নারী-পুরুষ সব জায়গায় সোমান কাজ করে।
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি নবাব আলী জানান, রাজশাহীতে শ্রমিকদের ২০ শতাংশও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন কোন ভবন মালিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দেন। তবে তুলনায় তা অনেক কম।

তিনি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি দীর্ঘ সময় থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বলে আসা হচ্ছে। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। আইন আছে প্রয়োগ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে তাদের নির্মাণ মিস্ত্রিদের গাফলিত রয়েছে। তারা ভবন মালিকদের থেকে ঠিকা (কন্টাকে) নিয়ে কাজ করছেন। তখন ভবন মালিক বলে দেয়- এখনে নির্মাণ কাজ চলাকালে কোন ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিকের ক্ষয়ক্ষতি হলে তার ভার কর্তৃপক্ষ নেবে না। সব দায় সাইটের হেড মিস্ত্রির।

রিয়েল এস্টেট এন্ড ডেভেলপার এসোসিয়েশন (রেডা) সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কাজী বলেন,
তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কোন কিছু করা হয়। করোনা ছাড়া বিভিন্ন সমস্যার কারণে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে তেমন কাজ করতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে কাজ করার চিন্তুভাবনা আছে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ