রাজশাহীর ভাষা সংগ্রামীদের সেনাপতি টিপু ভাই আর নেই

আপডেট: মার্চ ১৬, ২০২৪, ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ


ড. তসিকুল ইসলাম রাজা:রাজশাহীর ভাষা সংগ্রামীদের সেনাপতি খ্যাত অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু ভাইও পরিণত বয়ষ্কে অর্থাৎ ৯৬ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেছেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)-। তাঁর এই চলে যাবার মধ্যে যে গৌরব নিহিত রয়েছে তা সর্বজন বিদিত। তাঁর প্রাজ্ঞতা, যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মকুশলতা, বাগ্মীতা, নেতৃত্বদানের গুণাবলী এবং সত্যি তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বগুণসম্পন্ন মানুষ। তিনি কথায় ও কাজে এবং জীবনাচরণের প্রতিটি পরতে পরতে তাঁর স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ১৯৩১ সালের আগস্ট মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি চাঁপাই নবাবগঞ্জ হরিমোহন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরিক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন।

স্কুল জীবনেই তিনি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন এবং খেলাধুলা বিশেষত ফুটবল খেলায় তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। স্কুল জীবনে তিনি বাঘা বাঘা প্রধান শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষেই ইংরেজিতে নানা প্রশ্ন করতেন এবং তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে অনেকেই হিমশিম খেতেন। অবশ্যই তিনি লেখাপড়ার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। আবার খেলাধুলার মাঠেও তাঁর সরব উপস্থিতি সবাইকে আলোড়িত করতেন। সে সঙ্গে খেলাধুলার পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রমিক বিষয়ে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তব্য, ইংরেজিতে বক্তৃতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী।

তাঁর এক সহপাঠী বন্ধু বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, স্বনামধন্য লেখক, শিক্ষা প্রভাষক এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহম্মদ এলতাস উদ্দীন স্যার যথাযথই বলেছেন- ‘টিপু কোন বিষয়ই হেরে যাবার পাত্র ছিল না।… টিপু আমার সঙ্গে রাজশাহী কলেজে আই.এ কলা বিভাগে ভর্তি হয়। কলেজ হোস্টেলে অবস্থান করতেন।… টিপু ছিলেন রাজনীতি সচেতন ছেলে আর কলেজ হোস্টেলগুলো যে কোন আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। কলেজ রাজনীতির প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য টিপুর সুযোগ এসে গেল। তিনি যে কোন অনিয়ম, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সব সময়ই সোচ্চার। তাঁর সে সুযোগও মিলে গেল। ভাষা আন্দোলনের ফলে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে মিটিং-মিছিল হয়েছিলো সেগুলোতে টিপুর অবস্থান থাকতো সব সময়ই সামনের সারিতে।’

রাজশাহী কলেজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো আকাশচুম্বী। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে নেতৃত্ব দান করেছিলেন মুহম্মদ একরামুল, মোহাম্মদ সুলতান, মুহাম্মদ হবিবুর রহমান শেলী, মেসবাহ উল হক বাচ্চু, এম এ লতিফ প্রমুখ। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের ভূমিকায় ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু, এস.এম. এ গাফফার। সে সঙ্গে মোহসেনা বেগম, মনোয়ারা রহমান, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, সাইদ উদ্দিন আহমদ, আবুল কালাম চৌধুরী, মইনউদ্দীন প্রামাণিক, আবু সাঈদ, মোহাম্মদ আবুল হোসেন, লুৎফর রহমান মল্লিক, রওশন আরা খুকু, আবুল হোসেন, আমির হোসেন স্পেন, মোশারফ হোসেন আখুঞ্জি প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের সম্মুখভাবে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতেই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার যা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁরা সারারাত ধরে ইট, বালি, কাদা আর বাঁশ দিয়ে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সেই শহীদ মিনারের অমর ছবিটি ভাষা সংগ্রামী অ্যাডভোকেট মহসীন প্রামাণিকের সৌজন্যে পাওয়া যায়। সে সময় বামপন্থী নেতা এম.আতাউর রহমান আত্মগোপনে থেকে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদান করেছেন। গোলাম আরিফ টিপু সমগ্র জীবন এম আতাউর রহমানকে নেতা হিসেবে মান্য করেছেন।

সে সময় মুসলিম লীগের প্রধান নেতা রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান, এমএলএ এবং রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জননেতা মাদার বখশ, জননেতা ক্যাপ্টেন শামসুল হক, জননেতা মজিবুর, রহমান মিয়া প্রমুখ ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করায় গোলাম আরিফ টিপু ভাইয়ের সঙ্গে তাঁদেরও মুসলিম লীগ সরকার জেলখানায় আটক করে। রাজশাহী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তাঁর অনন্য ও অসাধারণ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

উল্লেখ্য, তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে বি.এ পাশের পর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এম.এ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ফজলুল হক মসলিম হলে অবস্থান করেছেন। ভালো ফুটবলার হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। গোল করার নিপুন কারিগর হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও সুনাম যেন প্রতিটি হলের ছাত্রদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। তিনি রাজনৈতিক জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর সেই সূত্রেই তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, সততা, সুনাম ও খ্যাতির কারণে তিনি জাতীয় রাজনীতির আশাতীত উচ্চতায় আরোহণ করেছিলেন। তিনি সারা জীবন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষনীয়। তিনি একজন উদার ও মুক্তমনের মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যবহার ও চালচলন ছিল অত্যন্ত রুচিশীল, উন্নত, মানবিক ও বন্ধুবৎসল।

তিনি আইন পেশায় নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘকাল তিনি রাজশাহী বারে ওকালতি করেছেন। সেখানেও তাঁর সততা, সুনাম মহৎ পেশার প্রতি অবিচল আস্থা রেখেই যাবতীয় দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সুসম্পন্ন করেছেন। তাঁর আইন পেশায় দীর্ঘ ক্যারিয়ার কোথাও কোন স্পট বা খুঁত নেই বললেই চলে। এ সব বিষয়ে কখনো কেউ কোনদিন কোনরূপ বিরূপ মন্তব্য বা মনোভাব পোষণ করতে পারেননি। প্রত্যেকটি মামলায় তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ ও আইনগত আলঙ্কারিক ইংরেজি বক্তব্য শুনে সবাই মুগ্ধ হতেন।

তাঁর ফেনিল ও কাব্যিক গদ্যভাষ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনর্গল বক্তব্য অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অতন্ত সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। পুরো নয় মাস তিনি ভারতে অবস্থান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন ভাষা সংগ্রামী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর আইন পেশায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সততা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শমণ্ডিত জীবন যাপনের কারণেই তাঁর যুদ্ধপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্নের জন্য যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিলো, সেখানে তাঁকে যথাযথ সম্মান দিয়েই সরকার চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমৃত্যু তিনি সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। এজন্য আমরা তাঁর কাছে অশেষ ঋণে আবদ্ধ।

তাঁর সারা জীবনের আদর্শ ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং দেশ ও জাতির প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার তাঁকে ২০১৯ সালের একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। এছাড়াও ২০২১ সালে তাঁকে তাঁর পবিত্র কর্মক্ষেত্রে রাজশাহীর নাড়ির স্পন্দন নামে খ্যাত ১৮৭২ সালের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান রাজশাহী এসোসিয়েশন পদক প্রদান করা হয়েছে। মৃত্যুকালে স্ত্রী, তিন কন্যা, আত্মীয় স্বজন ও অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা রাজশাহী এসোসিয়েশন, রাজশাহী লেখক পরিষদ এবং রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বারবার প্রণতি জানাই। সে সঙ্গে আমরা তাঁর আত্মার কল্যাণ কামনা করছি এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি।
লেখক- কবি ও প্রাবন্ধিক