চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কা

আপডেট: এপ্রিল ২১, ২০২৪, ১০:৪০ অপরাহ্ণ


সাজেদুল হক সাজু, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:


এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কায় চাষি ও ব্যবসায়ীরা। তবুও অল্প মুকুল নিয়ে চাষিদের মনে টিমটিম করে জ্বলছিল কিছুটা আশার আলো। কিন্ত সম্প্রতি চৈত্রের বৃষ্টিতে ঝরে গেছে এসব আমের মুকুল। ফলে পর্যাপ্ত গুটি আসেনি গাছে। আর কিছু গাছে এসেছে কচিপাতা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেক নামতে পারে এই জেলার আম উৎপাদন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেলার অর্থনীতি। ক্ষীণ হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হিসেব।
এদিকে চলতি বছরে জেলার মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। যা গত বছরের তুলনায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি। তবে মাঠ পর্যায়ের চিত্র একবারের ভিন্ন। চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নেমে আসবে আম উৎপাদন। কারণ এবার ৬০-৬৫ শতাংশ গাছেই আমের গুটি নেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ উপজেলায় একটি প্রথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন এমদাদুল হক। তিনি জানান, আমরা জন্মগত ভাবেই আম ব্যবসার সাথে জড়িত। আমার দাদা-বাবা সবাই এই আম ব্যবসায় করেছে। এই ধারাবাহিকতায় আমিও এই কাজ করে যাচ্ছি ১৫ বছর ধরে। কিন্তু গত ৪-৫ বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে পুজি প্রায় শেষ। তিনি আরও বলেন, গত বছর আমার প্রায় গাছে মুকুল এসেছিল। আমও হয়েছিল। কিন্তু তেমন দাম পায়নি। আর এবার গাছে মুকুল অনেক কম। তারপরও কয়েকদিন আগে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল।আমের সব গুটি,মুকুল পঁচে গেছ। এমনকি এখন প্রায় আম গাছে দেখে মনে হচ্ছে একটিও আম হবেনা। এতে আমি দুশ্চিন্তায় আছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ ইসরাইল মোড় এলাকায় বসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, আমার এবছর প্রায় ৬ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম বাগান রয়েছে। কিন্তু যে মুকুলগুলো আগে এসেছিল সেগুলোতে কিছু আম আছে। কিন্তু যে মুকুলগুলো পরে ফুটেছে সেগুলোতে একটিও আমের গুটি নেই। মুকুল সব পঁচে গেছে।

সদর উপজেলার আমচাষি ইসারুল ইসলাম বলেন, আমার সংসার চলে আমের টাকায়। কিন্তু এবার আমার গাছে আম নেই। বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। গাছে আম নেই আমার মন ভাল নেই। ঈদের হাসিমুখে থাকতে চাচ্ছিলাম। বাগান দেখতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বালাইনাশকের টাকা কিভাবে দিব তা মিয়ে চিন্তত আমি।
তিনি আরও বলেন, আমার সংসারে ৪ জন মানুষ সব খরচ চলে এই আমের টাকায়। কিন্তু এবার তো আম নেই কিভাবে সারাবছর সংসারের খরচ চালাব।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাচোল উপজেলার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, আমার বাগানের গাছগুলো বড়। আর মুকুলএ এসেছিল দেরিতে। বৃষ্টিতে সব মুকুল পচে গেছে। বেশিরভাগ মুকুলে একটিও আমের গুটি দেখা যাচ্ছেনা।

সারাদেশের সুমিষ্ট আম উৎপাদন হয় শিবগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের বসিন্দা রইসুদ্দিন আমল। তিনিও আম চাষ করছেন প্রায় ২০ বছর থেকে। তিনি জানান, এর আগেও আমে লোকসান করেছি। কিন্তু এবার আমের বাগান দেখে মনে হচ্ছে বেশি লোকসান হবে। কারণ বাগানে আম দেখতেই পাচ্ছিনা।

তিনি আরও বলেন, আমার একটি গোপালভোগ জাতের আম গাছ প্রতিবছর এই গাছে আম হয় প্রায় ২৫-৩০ মণ। এবারও মুকুল এসেছিল প্রচুর। কিন্তু আম হয়নি। কারণ মুকুলটা যখন ফুটন্ত তখন হয়েছিল বৃষ্টি। আর এতে পঁচে গেছে সব মুকুল।

আনারুল ইসলাম নামে এক চাষি জানান, আম বাগান পরিচর্যা করছি ধারদেনা করে। বাগানে আম থাকলে ধারদেনা করে ইদও চালিয়ে নিলাম। কিন্তু যাদের কাছে টাকা নিয়েছি তাদেরকে দিব কিভাবে। এবার ইদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। তাছাড়াও চাল, ডাল, তেলের দাম তো বাড়ছে। এমন অবস্থায় জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, জেলায় সব চেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় শিবগঞ্জে। কিন্তু এবার শিবগঞ্জে আমের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের চাষিদের আম বিক্রি করে কীটনাশক খরচ উঠবে কিনে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তিনি আরও বলেন, এবার আম বাগানে রোগ-বালাইও বেশি। এই রোগ-বালায়ের কারণে আমের গুটি ঝরে যাচ্ছে।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন শামীম খান বলেন, এবছর শীতের প্রকোপ অনেক বেশি ছিলো। আর জলবায়ূ পরিবর্তন হয়েছে। মূলত এ কারণেই আম বাগানে মুকুল কম। আর বৃষ্টিতে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বৈরি আবহাওয়া আমের জন্য হুমকি। আমের যখন প্রথম মুকুল আসে তখন থেকেই শঙ্কায় ছিলাম। দেরিতে আসা মুকুলের কোন ভরসা নেই। সবশেষ বৃষ্টিতে আমের মুকুলে ঝরে গেছে। এই জন্য আমাদের উপজেলায় প্রায় গাছেই আম নেই। আশা করছি জেলায় ৪০ শতাংশ গাছে আম হতে পারে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পলাশ সরকার বলেন, যেহেতু গত বছর আম গাছে প্রচুর মুকুল ছিলো। তাই এবছরকে অফ সিজন বলা যায়। তবে শীতের প্রকোপে বিশেষ করে বড় গাছে আমের মুকুল কম এসেছিল। তারপরও কয়েকদিন আগে ঘর কুয়াশা, অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে এতে আমের ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মুকুল ফোটার শেষ মুহুর্তে চৈত্রের বৃষ্টিতে মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

তিনি আরও বলেন, এবার যে বিরূপ আবহাওয়া চলছে। এতে আমের জন্য ভাল কিছু বয়ে আনবেনা। এমনকি সামনে আরও প্রকৃতিক দুর্যোগ আছে। যেমন কাল বৈশাখী ঝড়, শিলা বৃষ্টি এসব হতে পারে। এমনটা হলে আমের উৎপাদন আরো কমে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায় আমরা যে আম উৎপাদনের আশা করেছিলাম তা এবার নাও আসতে পারে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ