রাজশাহী বিভাগে একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ১১ জনের যাবজ্জীবনের রায়

আপডেট: মার্চ ১, ২০২৪, ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন আদালতে নানান অপরাধে একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রদান করেছে বিচারকগণ। এরমধ্যে নওগাঁয় স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ, রাজশাহীতে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর যাবজ্জীবন, ধর্ষণ চেষ্টায় শ্বশুরের পাঁচ বছর কারাদণ্ড, জয়পুহাটে জমি নিয়ে বিরোধে হত্যাা দায়ে ৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বগুড়ার শেরপুরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় স্বামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

যাবজ্জীবনের আমাদের নওগাঁ প্রতিনিধি বলেন, নওগাঁয় স্ত্রী হত্যার দায়ে এক ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। নওগাঁর বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আবু শামীম-আজাদ বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) এই রায় দেন। দন্ডপ্রাপ্ত আসামী মোস্তাফিজুর রহমান জেলার পোরশা উপজেলাধীন শাহপুকুর দীঘিপাড়া গ্রামের আকবর আলীর পুত্র।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ফাতেমা বেগম (২৬) পোরশা পূর্বগ্রাম (উস্তাপাড়া) গ্রামের মো. রবিউল ইসলামের কন্যা এর সাথে উক্ত অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানের বিয়ে হয় বেশ কিছুদিন আগে। তাদের বিবাহিত জীবনে ১টি মেয়ে সন্তান ও ১টি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে মোস্তাফিজুর রহমান স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে নিয়ে কুমিল্লা গিয়ে বসবাস শুরু করেন।

সেখানে বসবাসকালে দাম্পত্য জীবনে কলহ শুরু হয়। এক পর্যায়ে স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান গ্রামের বাড়িতে তার পিতা মাতার নিকট রেখে যায়। এরই এক পর্যায়ে সে বাড়িতে বেড়াতে আসে। ঘটনার দিন গত ২০২২ সালের ১২ জুন সকাল ৭টা থেকে ৭টা ১৫ মিনিটের মধ্যে স্ত্রী উক্ত ফাতেমা বেগমকে গলা টিপে হত্যা করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যার্নে বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।

ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। সংবাদ পেয়ে ফাতেমার পিতা রবিউল ইসলাম ঘটনার দিনই জামাই মোস্তাফিজুর রহমানকে একমাত্র আসামী করে পোরশা থানায় ৩০২/২০১ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে চার্জশটি দাখিল করে। পরবর্তীতে আসামীর বিরুদ্ধে দি প্যানেল কোড. ১৮৬০ এর ৩০২/২০১ ধারায় আভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযোগে উল্লিখিত ১৮ জন স্বাক্ষীর মধ্যে ১৩ জন স্বাক্ষীকে আদালতে হাজির করে স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। শুনানী শেষে অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হওয়ায় বৃহষ্পতিবার দুপুরে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ উক্ত আসামীর উপস্থিতিতে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন।

আদালত মৃত্যুদন্ড ছাড়াও আসামীর বিরুদ্ধে আরোও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার নির্দেশ করেন। রাষ্ট্রপক্ষে বিজ্ঞ পিপি এড. আব্দুল খালেক এবং আসামী পক্ষে স্টেট ডিফেন্স এড. মোঃ রফিকুল ইসলাম বেনু মামলাটি পরিচালনা করেন।

এদিকে রাজশাহীতে স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার জুথিকে হত্যার দায়ে স্বামী গোলাম মোস্তফাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। একইসাথে ওই পুত্রবধূকে ধর্ষণ চেষ্টার অপরাধে শ্বশুর আবুল কালামকে ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-২ আদালতের বিচারক মুহা. হাসানুজ্জামান এই রায় দেন।

আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দা শামসুন্নাহার মিতা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় ভুক্তভোগী সুমাইয়া আক্তার জুথির সাথে বিয়ে হয় আসামি গোলাম মোস্তফার। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থাকা অবস্থায় পুত্রবধূ যুথিকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে শ্বশুর আবুল কালাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুথি তার বাবার বাসায় চলে যায়।

বিষয়টি স্বামী গোলাম মোস্তফা জানতে পেরে প্রথমে তার বাবাকে হাসুয়া দিয়ে কোপ দিয়ে আহত করে। এরপর তার স্বামী জুথিকে তার বাবার বাড়িতে গিয়ে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এ ঘটনায় জুথির পরিবার ২০২২ সালে দুর্গাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।

তিনি আরও বলেন, বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-২ এর বিচারক মো. হাসানুজ্জামান আসামি গোলাম মোস্তফাকে ৩০২ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও শ্বশুর আবুল কালামকে ধর্ষণ চেষ্টা মামলায় পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া তাকে ২০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ডও দিয়েছেন আদালত।

আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, জয়পুরহাট সদরের সোটাহার ধারকী এলাকায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে দিনমজুর নুরুল হককে (৬৬) হত্যার দায়ে ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে জয়পুরহাটের অতিরিক্ত দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক নুরুল ইসলাম এ রায় দেন। রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জয়পুরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের মৃত ফরেজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রউফ (৬৬), মোহাম্মদ আলীর ছেলে রুহুল আমিন (৪১), আব্দুর রউফের ছেলে আলী হোসেন (৩৩), খোকন হোসেন (৩১), মৃত আছির উদ্দিনের ছেলে বেলাল হোসেন (৪৬), আক্তারুজ্জামানের ছেলে রোকন হোসেন (৩৩), বাবু হোসেন (৩১), মৃত আবু সাঈদের ছেলে মিজানুর রহমান (৫৬), মিজানুর রহমানের ছেলে সিরাজুল (৪১)।
এ সময় দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি ধান কাটছিলেন নুরুল হক হিচমী এলাকার আমান উল্লাহর বিবদমান জমিতে দিনমজুর হিসেবে। এ সময় উপরোক্ত আসামিরা নুরুল হককে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জখম করে। পরে বগুড়া শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই দিন দুপুরেই মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে মাছুম বাদী হয়ে ওই দিনই জয়পুরহাট সদর থানায় মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে আজ আদালতের বিচারক এ রায় দেন।

মামলার সরকারিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন নৃপেন্দ্র নাথ মণ্ডল পিপি, শামীমুল ইসলাম শামীম এপিপি, গকুল চন্দ্র মণ্ডল এপিপি। আর আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন হেনা কবির ও শাহানুর রহমান শাহিন।

সরকার-পক্ষের আইনজীবী শামীমুল ইসলাম-শামীম বলেন, দিনমজুর নুরুল হক হত্যা মামলায় বাদী-পক্ষ সঠিক রায় পেয়েছে। এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি।

আসামিপক্ষের আইনজীবী হেনা কবির বলেন, জয়পুরহাট সদর উপজেলার হিচমী এলাকায় নুরুল হক হত্যা মামলার রায় হয়েছে। এ রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

অন্যদিকে বগুড়ার শেরপুরে পঞ্চাশ হাজার টাকা যৌতুক না পেয়ে স্ত্রী নাজিরা খাতুনকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় স্বামী শামীম প্রামাণিককে (৩৪) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তাকে আরোও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ওই গৃহবধূর শ্বশুর-শাশুড়ি ও চাচা শ্বশুরকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বগুড়ার দ্বিতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবির এ রায় দেন। সাজাপ্রাপ্ত শামীমকে বগুড়া জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আদালতের স্পেশাল পিপি আশেকুর রহমান সুজন এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, শামীম প্রামাণিক বগুড়ার শেরপুরের দক্ষিণ আমাইল গ্রামের মাসুদ প্রামাণিকের ছেলে গত ২০১৩ সালের ১ম দিকে নাজিরা খাতুন পার্শ্ববর্তী নন্দীগ্রাম উপজেলার সোহাগীপাড়া গ্রামের ইউসুফ আলীর মেয়েকে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পর ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য শামীম তার স্ত্রী নাজিরার ওপর নির্যাতন শুরু করেন। ওই বছরের ১১ মে রাতে যৌতুক নিয়ে ঝগড়ার একপর্যায়ে শামীম পিটিয়ে স্ত্রী নাজিরাকে হত্যা করেন।

এ ব্যাপারে তার বাবা ইউসুফ আলী শেরপুর থানায় জামাই শামীম প্রামাণিক, তার বাবা মাসুদ প্রামাণিক, মা মনোয়ারা বিবি ও মেয়ের চাচা শ্বশুর নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা শেরপুর থানার তৎকালীন এসআই আবু জাররা ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আদালতে চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট শেখ রেজাউর রহমান মিন্টু মামলা পরিচালনা করেন।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ