লিজ নেয়া খাস জমি বিক্রি হচ্ছে দুই কোটি টাকায়!

আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:


রাজশাহীতে একটি সমবায় সমিতির নামে লিজ নেওয়া মূল্যবান খাস জমি রাতারাতি দুই কোটি টাকায় বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য ধনাঢ্য দুই ব্যক্তির সঙ্গে হস্তান্তরনামা দলিলও করা হয়েছে। এই অনিয়মের ব্যাপারে সমিতিরই এক সদস্য বাদি হয়ে মামলা করেছেন। জেলা প্রশাসন বলছে, লিজ নেওয়া খাস জমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।

এই সমিতিটির নাম রাজশাহী রিফিউজি কো-অপারেটিভ স’মিল লিমিটেড। এটি ভারত থেকে রাজশাহীতে আসা মহাজের বা রিফিউজি কাঠ মিল ব্যবসায়ীদের সংগঠন। ১৯৫২ সালে সমিতিটি নিবন্ধন পায়। এর নিবন্ধন নম্বর-২২। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জেলা প্রশাসক রাজশাহী নগরীর গোরহাঙ্গা এলাকায় ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত সাড়ে ১৪ কাঠা খাস জমি সমিতিটিকে ইজারা দেয়। এখনও ওই ইজারা চলমান।

আইন অনুসারে, লিজ নেয়া খাস জমি বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেয়। কিন্তু গত ৩ মার্চ এই সম্পত্তি বিক্রির জন্য নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে হস্তান্তর-নামা দলিল করা হয়। তেলেসমাতি এই কারবারে দলিলের প্রথমপক্ষ হিসেবে সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার আনসারী, সাধারণ সম্পাদক আসলাম পারভেজ, সদস্য আরিফ ইকবাল, মো. সরফরাজ এবং জুলেখা খাতুন নুরীর নাম লেখা হয়। আর ক্রেতা হিসেবে দ্বিতীয়পক্ষে আছে নগরীর হেতেমখাঁ এলাকার ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান সরকার এবং তার ভাই আশাফউজ্জামান সরকার।

দলিলে উল্লেখ আছে, দুই কোটি ৫ লক্ষ টাকায় এই জমিটি বিক্রি করা হচ্ছে। চুক্তির দিন দ্বিতীয়পক্ষ-প্রথমপক্ষকে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। এছাড়া এন.আর.বি.সি ব্যাংকের রাজশাহী শাখার ৫৫০৫২২০ নং চেকে গত ৩১ মার্চের তারিখে এক কোটির একটি চেক দেওয়া হয়। এছাড়া ৫৫০৫২২১ নম্বর চেকে আরও একটি এক কোটি টাকার চেক দেওয়া হলো। দ্বিতীয় চেকটি নগদায়ন করা যাবে আগামী ৩১ মে। সেদিন চেকে টাকা উঠানো-না গেলে চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। রাজশাহী নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে এই হস্তান্তর-নামা দলিলের নিবন্ধন নং-০০০০১৮২১।

নগরীর প্রাণকেন্দ্রের মহামূল্যবান এই জমি বিক্রির অপচেষ্টার বিষয়ে জানতে পেরে গত ৩ এপ্রিল সমিতির সহ-সভাপতি সোবহান বাদী হয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে একটি মামলা করেছেন। এতে আরিফউজ্জামান সরকার, তার ভাই আশিক উজ্জামান সরকার, বিপ্লব সরকার এবং তাদের সহযোগী এমদাদুল হক বাবুকে আসামি করা হয়েছে। তারা অবৈধভাবে জমিটি দখলের চেষ্টা করছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার বাদী সোবহান বলেন, আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে এই জমির ইজারা চলে আসছে। এ জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখায় নিয়মিত লিজের অর্থ জমা দিতে হয়। সরকারি এই জমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ পাঁচ সদস্য আর্থিকভাবে লাভবান হতে অবৈধভাবে জমিটি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এমদাদুল হক বাবু জমি কেনার জন্য টাকা দিচ্ছেন। তাই মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।

এদিকে সমিতির পাঁচ সদস্যের সঙ্গে জমি কেনার জন্য হস্তান্তরনামা দলিল করার পর থেকেই আসামিরা জমিটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। জমিতে সমিতির পক্ষ থেকে বেশকিছু দোকানপাট করে ভাড়া দেওয়া আছে। ভাড়াটিয়ারা জানান, সম্প্রতি মামলার এই আসামিরা গিয়ে তাদের দোকান ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেছেন। তারা দোকান ছাড়তে না চাইলে গালিগালাজ করা হয়। আসামিরা তাদের কাছে দাবি করেছেন, জমির মালিক এখন তারা। এ সময় সমিতির আরেক সদস্য মো. আলমগীর বাধা দিতে গেলে আসামিরা তাকে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ নিয়ে আলমগীর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

হস্তান্তর-নামা দলিল করার কথা স্বীকার করলেও সবকিছু পড়ে দেখেন নি বলে দাবি করেন স’মিল সমিতির সভাপতি আবদুল জাব্বার-আনসারী। তিনি স্বীকার করেন, লিজ নেয়া এই জমি বিক্রির ক্ষমতা তার নেয়। এরপরও দলিল করার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দেননি।

খাস জমি কিনতে হস্তান্তর-নামা দলিল করার বিষয়ে কথা বলতে আরিফুজ্জামান সরকারের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তার ভাই বিপ্লব সরকার’কে কয়েক দফা ফোন করা হলেও রিসিভ করেনি। তাদের সহযোগী এমদাদুল হক বাবু বলেন, এই জমির মূল মালিক আরিফুজ্জামান সরকারের প্রয়াত বাবা। যেভাবেই হোক এখন এটার দখলে আছে স’মিল সমিতি। তাই তাদের কাছ থেকে আপসে জমির দখল নিতে দুই কোটি টাকার চুক্তি করা হয়েছে।

তবে-সবশেষ ২০২৩ সালের ১ আগস্ট রাজশাহী’র বড়কুঠি ভূমি-অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী-কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত ৪৫৩৬ এবং ৪৭১৯ নং দাগের এই জমির শ্রেণি স’মিল। এটি বাংলাদেশ সরকার’র পক্ষে ডেপুটি-কমিশনার, রাজশাহী নামে প্রচলিত। দাগে মহাজেরিন সমবায় সমিতি লেখা রয়েছে। লিজ দেয়া এই জমি বিক্রির-চেষ্টার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা-প্রশাসক (রাজস্ব) আনিসুল ইসলাম বলেন, লিজ নেয়ার পর-খাস জমি বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের আইনগত কোনো সুযোগ নেয়। আমি ঢাকায় প্রশিক্ষণে আছি। ফেরার পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ