নাটোরের হাতে ভাজা মুড়ির কদর রমজানে বাড়ে কয়েক গুণ

আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৪, ১১:৩৬ অপরাহ্ণ


নাটোর প্রতিনিধি:রমজানে ইফতারে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো মুড়ি। ইফতারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই মুড়ি যেন জুড়ি নেই। তবে সেটা যদি হাতে ভাজা হয় তাহলে তো কথাই নেই। দীর্ঘদিন ধরে নাটোরে হাতে ভাজা মুড়ির প্রচলন হয়ে আসছে। এর স্বাদ মেশিনে ভাজা কিংবা প্যাকেটজাত মুড়ির চেয়ে ভিন্ন। খেতেও অনেক সুস্বাদু। সাধারন ক্রেতাদের কাছে হাতে ভাজা মুড়ি বেশ জনপ্রিয়। এখান থেকে মুড়ি কিনে ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের নানান অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে পাইকাররা। তবে, এবার ধানের দাম বেশি হওয়ায় লাভ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মুড়ি উৎপাদনকারীরা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মুড়ি ভাজার কাজে নিয়োজিত বাড়ির মেয়েদের কেউ উঠানে ধান শুকাচ্ছে। আবার কেউ মাটির চুলায় চাল গরম করছে আর সেই চাল নারিকেলের খিল কিংবা পাটসোলা দিয়ে নাড়াচারা করছে। কেউবা সেই গরম চাল মাটির পাতিলে রাখা বালিতে পাটসোলা দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। পরে তা মাটির খাঁজ কাটা ঝাঁজর নিয়ে তাতে হাতে বানানো মাঝাড়ি সাইজের ঝাড়ু নিয়ে ধীরে ধীরে নাড়তে হয়। এরপর মুড়ি ফুলে লাল হয়ে আসলে নামিয়ে নিতে হয়। গ্রাম বাংলার নারীরা বাসায় এই মুড়ি বেশি বানিয়ে থাকেন। একটু কান পাতলে শোনা যায় বাতাসে ঝনঝন শনশন মুড়ি ভাজার শব্দ। প্রতি বাড়িতেই মুড়ি ভাজার জন্য রয়েছে আলাদা ঘর।

জানা যায়, নাটোর সদর উপজেলার গোয়ালদিঘী, কৃষ্ণপুর,বারুহাটি, বাকশোর, তেগাছি, ও ঢাকোপাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি হতে দেখা যায়। কোন রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়াই এখানকার মুড়ি তৈরি হয় বলে দেশব্যাপি এ মুড়ির কদর রয়েছে। এসব গ্রামের মুড়ি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে পাশের ডালসড়ক এলাকায় গড়ে উঠেছে মুড়ির আড়ৎ।

স্থানীয় মুড়ি বিক্রেতা এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের সমাগম ঘটে এই আড়তে। ওই আড়ৎ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ২ শ মণ মুড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
এদিকে খুচরা দোকানীরা এবং ক্রেতারা বাসায় খাওয়ার জন্য এসব হাতে ভাজা মুড়ি কিনেন। যার কারণে নাটোর নীচা বাজার নাম পড়ে যায় মুড়ি পট্টি।

গোয়ালদিঘী গ্রামের মুড়ি উৎপাদনকারী মকসেদ আলী বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বাড়িতে মুড়ি উৎপাদন করছি। মুড়ি বিক্রি করে সংসার চলে যায়। রমজান মাস এলে মুড়ির চাপ বেড়ে যায়। আমাদের গ্রামের হাতে ভাজা মুড়ির সুনাম দেশজুড়ে।

তেগাছি গ্রামের আব্দুল জব্বার বলেন, এই মুড়িতে কোনো রাসায়নিক সার দেয়া হয় না। লবণ আর বালু দিয়ে ভাজা হয় মুড়ি। তাই সারা বছর ধরে আমাদের মুড়ির চাহিদা বেশিই থাকে। আমন, বিনা-৭, হরি ধান, ২৯ ধান, ১৬ ধান, ৫২ ধানের মুড়ি উৎপাদিত হয় এখানে।

ঢাকোপাড়া গ্রামের আসিয়া বেগম বলেন, ১ মণ চালের মুড়ি ভাজলে ১০ থেকে ১২ কেজি মুড়ি তৈরি হয়। অন্য সময় আমরা রাত ১টা থেকে ২টার মধ্যে মুড়ি ভাজা শুরু করে পরদিন সকাল ৯টা ১০টা পর্যন্ত মুড়ি ভাজার কাজ করি। তবে রমজান মাসে আমরা প্রায় সারাদিনই মুড়ি ভাজি।

ক্রেতা কামাল হোসেন বলেন, মেশিনের মুড়ির স্বাদ ভালো হয়না। কিন্তু হাতে ভাজা মুড়ি অনেক সুস্বাদু এবং খেয়েও তৃপ্তি পাওয়া যায়। তাই প্রতিবছর এখান থেকেই মুড়ি কিনে নিয়ে যাই।
ক্রেতা সেফালী নাসরিন বলেন, গত বছরের তুলানায় এ বছর মুড়ির দাম বেশি মনে হচ্ছে। যে মুড়ি আগে ৫৬ টাকা কেজিতে কিনেছি এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। আর হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।

মুড়ির ব্যবসায়ী অহিদুল ইসলাম বলেন, রোজার পাশাপাশি আম, কাঁঠালের মৌসুমে মুড়ির চাহিদা বাড়ে। আমন মুড়ি প্রতি মণ ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকা, ১৬ ধানের মুড়ি ৩ হাজার টাকা থেকে ৩১০০ টাকা ও অন্যান্য মুড়ি গড়ে ২৫০০ থেকে ২৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এ আড়তে বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকার মুড়ি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, শরিফুল ইসলাম বিদ্যুৎ জানান, গ্রামে হাতে ভাজা মুড়ি তৈরিতে নারীদের পাশাপাশি মুড়ি ভাজা থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এখানকার পুরুষরা। ভোর থেকে ভাজা শুরু হওয়া এসব মুড়ি সকাল হলে নিয়ে যাওয়া হয় আড়তে।

স্বল্প পুঁজির এই ব্যবসা করে গোয়ালদিঘী কৃষ্ণপুর গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের মানুষরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও স্থানীয় কোনো ব্যাংক এগিয়ে আসেনি তাদের পাশে। স্বল্প সুদে এসব মুড়ি উৎপাদনকারীদের ঋণ সহায়তা দিলে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন মুড়ি উৎপাদনকারীরা। তাদের দাবি, সরকার তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা বেশী করে মুড়ি।