পঁচিশে বৈশাখ অনুভবের সুধাময়তা

আপডেট: মে ৮, ২০২৪, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির:


‘পঁচিশে বৈশাখ’ শব্দযুগল আমার কাছে একটা চারুমধুময় সময়ের সৃষ্টি করে। তখন স্থান-কাল-পাত্র হারিয়ে একটা ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ কে সর্বান্তকরণে স্থান করে নিতে ইচ্ছে জাগে। এই দিনে রবীন্দ্রনাথ ধরার ধুলায় আগমন করেন। তাঁর জন্মদিন আর পাঁচটি ঘটনার মতো নয়। তিনি কিংবা তার পরিবার-ঘনিষ্ঠরা প্রথম দিকে ভেবে দেখেন নি, বিষয়টি। অথচ তিনিই সবাইকে ছাড়িয়ে ‘চির বিস্ময়’ হয়ে আছেন। এই অভিধাটি গীতবিতানের আনুষ্ঠানিক সংগীত শাখার সতেরো সংখ্যক গান। রচনাকাল শেষ জন্মদিন অনুষ্ঠানের দুদিন আগেÑ২৩ শে বৈশাখ, ১৩৪৮।

দশ বছর আগে ‘জন্মদিন’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন: ‘এজন্মের গোধূলির ধূসর প্রহরে/ বিশ্বরসসরোবরে/ শেষবার ভরিব হৃদয় মন দেহ/ দূর করি সব কর্ম, সব তর্ক, সকল সন্দেহ/ সব খ্যাতি, সকল দূরাশা/ বলে যাব, ‘আমি যাই, রেখে যাই মোর ভালোবাসা।’ (শান্তিনিকেতন, ২৩ শে বৈশাখ, ১৩৩৮)

১৩১৭ বঙ্গাব্দের ‘পঁচিশে বৈশাখ’ একেবারে নিজের জন্মদিন নিয়ে কথা বললেন, ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের বালকদের লক্ষ্য করে। “আজ আমার জন্মদিনে তোমরা উৎসব করে আমাকে আহ্বান করেছÑএতে আমার অনেক দিনের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে’… এই নবজন্মে বংশ গৌরব নেই, আত্মভিমান নেই, রক্তসম্বন্ধের গন্ডি নেই, আত্মপরের কোনো সংকীর্ণ ব্যবধান নেই…। এই মঙ্গললোকে স্বার্থবুদ্ধি নয়, এখানে আমাদের পরস্পরের যোগ সম্বন্ধ, কেবল সেই একের বোধে অনুপ্রাণিত মঙ্গলবুদ্ধি দ্বারাই সম্ভব।’ (জন্মোৎসব, রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৫৫৬) আমরা মনে করি কবির এই বক্তৃতা কেবল আশ্রম বালকদের জন্য নয়। বিবেক সম্পন্ন মানব সমাজের জন্য।

গত শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে শান্তিনিকেতন জোড়াসাকো ইত্যাদি স্থানে রবীন্দ্র জন্মোৎসব উদযাপন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রতিটি জন্মদিন উৎসবে ব্যক্তিগত অনুভবের প্রকাশ। তবে শেষের জন্মদিনের উৎসবে তিনি যে গানটি রেখে গেছেন, তাই তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। আমরা অধিক গভীরে যাব না। কেবল তার পঁচিশে বৈশাখ কেন্দ্রিক গানটি, যা আগেই উল্লেখ করেছি। এই বছরই অর্থাৎ ১৯৪১ সালে ত্রিপুরা সরকার রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি একালেই রচিত।

জীবন সায়াহ্নে একে জীবনের নিবিড় অনুভূতি এ গানে লক্ষণীয়। আমরা পড়ে দেখতে পারি: “হে নূতন,
দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাট, সূর্যের মতন।”

এই সূর্য প্রকৃতির সেরা সৃজন, তাই ছিলো তার নাম রবি। পরে ইন্দ্রযোগ পুরুষাণুক্রমিক। তবে এই নাম যে কত তৎপর্যময় হয়ে উঠেছে তা আমরা আজও অনুভব করছি। তিনি বলে উঠলেন, “ব্যক্ত হোক, জীবনের জয়, ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়।’ অসীম শব্দের অভিধানিক অর্থ, অনন্ত, অশেষ, সীমাহীন। আমরা ভাবের অর্থে স্রষ্টাকে জানি, সে ব্যাখ্যা আমাদের নয়। আমরা আমাদের পরিচিত সমাজ-সংসার দিয়েই তা বোঝার চেষ্টা করবো রবীন্দ্র উপলব্ধিকে।

জীবনের জন্য ক্ষুৎ-পিপাসা, প্রেম-ভালোবাসা, বিদ্বেষ বিরূপতা সবই আছে। তবে ভালোবাসার স্থানটাই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ এবং স্মরণীয়। এই ভালোবাসাকে তিনি মনিরথে আকীর্ণ করে গেছেন। তারতো কোনো সীমা নেই। গীতবিতানের পূজা পর্বের একটি গান, যেটি ব্রহ্মসংগীত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছিলো, সে তা কেবল পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি যাই’ সে প্রাজ্ঞ জীবনের অতুল উপলব্ধি না হোক সাধারণ চেতনায় আমাদের উন্মুলিত করে তোলে, আমরা আকুল হই। এমনি ভাবে যে অর্থ ধরেই আমরা প্রবেশ করি না কেন, আমাদের আকুল করে তোলে, না পাওয়াকে পাওয়ার জন্য। পাই না বলে তো ‘প্রাণ মন লয়ে’ খুঁজে বেড়াই। পাই না, আর পাওয়াও যায় না। পেলে এমন অনন্য ধ্বনি কোথা থেকে বেজে উঠতো!

কবিগুরু অভিধাটি মধুসূদন ব্যবহার করেছিলেন, আদি কবি বাল্মীকিকে স্মরণ করে। রবীন্দ্রনাথ সেই আদিকবিকে কবিগুরু বলে সম্বোধন করেছেন। তবে তাঁকে যখন কবিগুরু বলা হলো, তখন তা তিনি গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি মনে করতেন ‘আমি তোমাদের লোক’। তিনি আমাদের লোক হয়েই থাকুন। আমাদের সকল অতৃপ্তি তাঁর তার বাণীতেই ধ্বনিত হোক। ‘তবুও বলি শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে।’ না, তিনি বলেন নি। এ এক বিস্ময়। সেই বিস্ময় নিয়েই আমরা তাঁকে স্মরণ করতে থাকবো। আমাদের নিজের পরিমণ্ডলে।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ