রবীন্দ্রনাথ এবং অসাম্প্রদায়িকতা

আপডেট: মে ৮, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ


মজিবুর রহমান:


রবীন্দ্রনাথ সকল সময়ে সকল ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা এবং মানব প্রেমকে প্রণাম করে চলেছেন। তাঁর মতে ধর্ম এবং সমাজ মানুষের হাত দ্বারা গঠিত হয়েছে অথচ মানুষ সৃষ্টিকর্তার হাতে সৃষ্টি। তাই আমাদের মানুষকেই প্রাধান্য দিতে হবে, ধর্ম কিংবা সমাজকে নয়। মানুষকে ভালোবাসলেই আমরা ধর্ম পাবো, সমাজ পাবো, স্বর্গ পাবো এবং সর্বোপরি আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে পাবো। জৈবসত্তা এবং আত্মিকসত্তার পূর্ণাঙ্গ রূপই হচ্ছে মানুষ। এই মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখতে পাওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের তিনটি অভিমত উদ্বৃতি যোগ্য।
এক. আমার দেবতা মানুষের বাইরে নেই। নির্বিকার নিরঞ্জনের অবমাননা হচ্ছে বলে আমি ঠাকুরঘর থেকে দূরে থাকি। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে বলেই আমার নালিশ।

দুই. আমার ভগবান, মানুষের যা শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে। তিনি মানুষের স্বর্গেই বাস করেন।
তিন. আমার ঠাকুর মন্দিরে নয়, প্রতিমাতেও নয়, বৈকুণ্ঠেও নয়, আমার ঠাকুর মানুষের মাঝে।

বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ যেমন কালজয়ী পুরুষ, মানুষের ভাগ্যাকাশেও তিনি অবিশ্বরণীয় ধর্মবর্ণহীন মানবতাবাদী এক দার্শনিক। ব্যক্তিসত্তা, সৃষ্টিসত্তা সর্বক্ষেত্রেই তিনি মানবতাবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক। এক্ষেত্রে বলা যায়, যিনি যা ভাবেন না, তা দিয়ে তাকে বিচার করা সমীচীন নয়। মানুষকে মানুষের মত করেই বিচার করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ যা ভেবেছেন, যা বলেছেন তা দিয়েই আমরা তার বিশ্লেষণ করবো। তবে চলুন আমরা সে পথেই এগোনোর চেষ্টা করি।

এক. বাংলাদেশে আমরা একসময় স্বদেশি আন্দোলন লক্ষ্য করেছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে বিবর্তনের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিবেচনা ও অবিবেচনা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘সেদিন সমাজটাও যেন আগাগোড়া নাড়িয়া উঠিল এমনতর বোধ হইয়াছিল।… এমনকি, হিন্দু-মুসলমানে একত্রে বসিয়া আহার করার আয়োজনটাও হয় হয় করিতে লাগিল।’

দুই. এদেশে হিন্দু-মুসলমান বিবাদ বিসম্বাদের জন্যে হিন্দুরা যে অনেকাংশে দায়ি, সেকথা অকপটে স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে বলেন, ‘বঙ্গ বিচ্ছেদ ব্যাপারটা আমাদের অন্ন-বস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করেছিল।… বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনদিন হৃদয়কে এক হইতে দেই নাই।’

তিন. হিন্দু সমাজের কুপমণ্ডকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি তাঁর ‘বাতায়নিকের পত্র’ প্রবন্ধে বলেন, ‘অল্পকাল হল একটা আলোচনা আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছি, তার সিদ্ধান্ত এই যে, পরস্পরের মধ্যে পাকা দেওয়ালের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও এক চালের নীচে হিন্দু-মুসলমান আহার করিতে পারিবেনা। এমনকি সেই আহারে হিন্দু-মুসলমানের নিষিদ্ধ কোন আহার্য যদি নাও থাকে। যাহারা একথা বলিতে কিছুমাত্র সংকোচবোধ করেন না কিন্তু মুসলমানদের বিরোধের সময় তাঁহারাই সন্দেহ করেন যে, বিদেশী কর্তৃপক্ষেরা এই বিরোধ ঘটাবার মূলে।’

চার. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুক্তিবাদী দার্শনিক। যুক্তি ছাড়া বিশেষ কোনো কিছুই তিনি গ্রহণ করতে চাননি। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নেও তিনি নমনীয় ছিলেন না। অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং কুসংস্কারের আবর্তে যারা আবর্তিত তাদের লক্ষ্য করে তিনি তার ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘ধর্ম যখন বলে মুসলমানদের সঙ্গে মৈত্রী করো তখন কোন তর্ক না করিয়াই কথাকে মাথায় করিয়া লইব।… কিন্তু ধর্ম যখন বলে মুসলমানদের ছোঁওয়া অন্ন গ্রহণ করিবেনা, তখন আমাকে প্রশ্ন করিতেই হইবে, কেন করিবনা ?’

চার. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মানুষের কবি, মানবতার কবি। তিনি বলেন, মানুষে মানুষে মহামিলনের তীর্থক্ষেত্র রচিত না হলে বিশ্বশান্তি সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে বলেন, ‘আমি যখন প্রথম আমার জমিদারী কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম, তখন দেখেছিলুম কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে জাজিমের একপ্রান্ত তুলিয়া দিয়া তাহাদেক স্থান দেওয়া হত। অন্য আচার অবলম্বনকারীদের অশুচি বলিয়া গণ্য করার মত মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছুনে। আমার অধিকাংশ প্রজাই মুসলমান। কোরবানী নিয়ে দেশে যখন একটা উত্তেজনা প্রবল, তখন কিছু হিন্দু প্রজারা আমাদের এলাকায় সেটি সম্পূর্ণ রহিত করার জন্য আমার কাছে নালিশ করিয়াছিল। সে নালিশ আমি সঙ্গত বলে মনে করিনি।’

এগুলো মূলতঃ রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক চেতনা। ব্যক্তিগত জীবন আচরণেও সাম্প্রদায়িকতার বিন্দু মাত্র ছিল এমনটি মনে হয় না। এ সম্পর্কে শ্রী উদয় লাহিড়ীর কিছু স্মৃতি তুলে ধরা যেতে পারে। লাহিড়ী বাবু একসময় জমিদারী পরগনা পতিসরে গিয়েছিলেন। জনৈক ব্যক্তি হাজী ইয়ারদী প্রামানিক ও মুলি প্রামানিকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁরা বলেন, কবি ছিলেন আল্লাহর খাস বান্দা। এত ভালো লোক আর হয়না। শিলাইদহ পরগনার জনৈক মো. মাদার আলী বলেন, কবির সঙ্গে বসলে কেউ বুঝতে পারতনা কে জমিদার আর কে প্রজা।

এরই নাম বিশ্বকবি, এরই নাম মানবতার মানস পুত্র, এরই নাম অসাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ। যুগে যুগে আমরা এরূপ অসাম্প্রদায়িক মানুষে খুঁজে ফিরি। মানবতার জয় হোক, অসাম্প্রদায়িকতার জয় হোক।