দন্ত চিকিৎসক ডা. গোলাম হোসেন ও তাঁর ভাস্কর্যের জগৎ

আপডেট: এপ্রিল ২৮, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ


ড. ইমরুল কায়েস তপন:


রাজশাহীর শিল্পকলার জগতে শিল্পী ডা. গোলাম হোসেন উজ্জ্বল একটি নাম। তাঁর ভাস্কর্য চর্চার সূত্রপাত স্বাধীনতা পূর্ব সময় অর্থাৎ পাকিস্তান পর্বে। এই সময় বলা যায় তিনি এককভাবে ভাস্কর্য চর্চা করে এই অঞ্চলে বিষয়টির সার্বিক বিকাশ ও চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

শিল্পী ডা. গোলাম হোসেনের জন্ম ১৯২৬ সালে রাজশাহীর চারঘাট থানার সরদহের থানাপাড়ায়। পিতা গোসাব্বাস আলী ও মাতা সফুরা খাতুন। তিনি ১৯৫৪ সালে বাগমারার বাহমনী গ্রামের খায়রুন্নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির তিন সন্তান। জ্যৈষ্ঠ সন্তান মো. ইয়ামুস সিনা ব্যবসার সাথে জড়িত। দ্বিতীয় সন্তান মোহাম্মদ আলী পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দন্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র কন্যা ফারাহ্ দিবা বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থল সংযুক্ত আরব আমিরাতে সপরিবারে বসবাস করছেন।

গোলাম হোসেন মেট্রিকুলেশন পাশ করেন সাতচল্লিশ-পূর্ব সময়। এরপর কলকাতায় দন্ত বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি কিছুদিন করাচিতেও বসবাস করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকেই তিনি রাজশাহীতে দন্ত চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথমে তাঁর চেম্বার ছিলো নগরীর মালোপাড়ায় ভুবনমোহন পার্কের উত্তরে। পরবর্তী সময় নিউমার্কেটে ‘ডায়মন্ড ডেন্টুরা’ নামে চেম্বার প্রতিষ্ঠা করে আমৃত্যু সেখান থেকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। গোলাম হোসেন ষাটের দশকে রাজশাহী জেলখানা কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কারা দন্ত চিকিৎসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

শিল্পী গোলাম হোসেন চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি শিল্প চর্চা করেছেন। তাঁর ভাস্কর্য চর্চার পেছনের কারণ হয়তোবা তাঁর পেশা। কারণ দন্ত চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে প্রতিনিয়তই তাঁকে প্লাসটার অব প্যারিসের সাহায্যে দাঁতের মডেল তৈরি করতে হতো। আর এখান থেকেই তিনি ভাস্কর্যচর্চার অনুপ্রেরণা পান বলে মনে করেন তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান মো. ইয়ামুস সিনা। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সুলতানাবাদের বাসায় বাবা তাঁর নিজস্ব স্টুডিও এবং চেম্বার- এই দুুই জায়গাতেই ভাস্কর্যের কাজ করতেন। দুপুরে অফিস থেকে বাসায় ফিরে কিছু সময় এবং রাতে দুই ঘণ্টা করে নিয়মিত ভাস্কর্য চর্চা করতেন তিনি।’ ( সাক্ষাৎকার তাং- ১৬ জানুয়ারি ২০২৪)।

শিল্পী গোলাম হোসেন প্রতিকৃতি ও পূর্ণাবয়ব- এই দুই ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। প্লাস্টার অব প্যারিসের সাহায্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলতে তিনি ব্যবহার করেছেন তেলরঙ। এছাড়া ট্রান্সপারেন্ট শিটকে হিট দিয়ে বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে চোখ তৈরি করে তা মুখাবয়বে সংযোজন করতেন। ভাস্কর্যগুলোর অভিব্যক্তিও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে গোলাম হোসেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। আইয়ুব খান তাঁর কাজের প্রশংসা করে তাঁকে সার্টিফিকেট প্রদান করেন। প্রায় সমসাময়িক সময় ওয়াপদার তৎকালীন চেয়ারম্যান জি এম মাদানি নিজের ভাস্কর্য নির্মাণের ইচ্ছে পোষণ করলে গোলাম হোসেন তাঁরও ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, মাদানি সাহেবের ফটোগ্রাফ দেখে তিনি এটি নির্মাণ করেন।

১৯৬৫ সালের দিকে গোলাম হোসেন রাজশাহীর খ্যাতিমান চিকিৎসক ডা. সুলতান আহমেদের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ফটোগ্রাফ ও সুলতান সাহেবকে সরাসরি দেখে তিনি এটি নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির উচ্চতা আনুমানিক ২৪ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১৮ ইঞ্চি বলে জানান ডা. সুলতান আহমেদের পুত্র সাব্বির সুলতান। ( সাক্ষাৎকার তাং- ২৬ জানুয়ারি ২০২৪)।
১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন শিল্পী গোলাম হোসেন। যদিও ভাস্কর্যটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর।

গোলাম হোসেন তাঁর স্ত্রী খায়রুন্নেছার প্রতিকৃতি ও পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্যও নির্মাণ করেন। এছাড়া নব্বই-এর দশকে বরেন্দ্র গবেষক আব্দুস সামাদের উদ্যোগে কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করে বরেন্দ্র জাদুঘরে দিয়েছিলেন প্রদর্শনের জন্য।

শিল্পী গোলাম হোসেন পুতুল তৈরিতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। পুতুলগুলোতে তিনি যন্ত্র সংযোজন করতেন। ফলে সেগুলো হাত-পা নাড়তো ও ঘুরতো। এছাড়া নিজের ব্যবহারের জন্য তিনি চশমা, কলম, চামুচ, স্যুটকেস ইত্যাদিও তৈরি করতেন।

গোলাম হোসেনের শিল্পসত্তার প্রধান দিক তাঁর সহজ-সরল প্রকাশ ভঙ্গিমা। তিনি যা দেখেছেন এবং যতটুকু দেখেছেন, তাই ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রয়োজনে কিছুটা কল্পনারও আশ্রয়ও নিয়েছেন।
গোলাম হোসেন এমন এক সময় ভাস্কর্য চর্চা শুরু করেছিলেন যখন এর চর্চা ছিল খুবই সীমিত। শিল্পী আশফাকুল আশেকীন বলেন, ‘পাকিস্তান পর্বে স্কুল, টিটি কলেজ এর সিলেবাসে ভাস্কর্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। তবে রাজশাহী শহরের কয়েকটি স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজোর জন্য প্রতিমা নির্মাণ করা হতো। সেই সময় রাজশাহীতে ভাস্কর্য চর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে এবং এর উৎকর্ষ সাধনে শিল্পী গোলাম হোসেনের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। (সাক্ষাৎকার তাং- ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

গোলাম হোসেন শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা কিংবা অনুষ্ঠানেও শরিক হওয়ার চেষ্টা করতেন। শিল্পী এম এ কাইউম বলেন, ‘নব্বই-এর দশকে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বাংলার অধ্যাপক ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য পরিষদ’-এর নিয়মিত আড্ডা হতো নিউমার্কেট সংলগ্ন হকার্স মার্কেটে। শিল্পী গোলাম হোসেন মাঝে মাঝে সেই আড্ডায় সামিল হতেন। শিল্পকলা ও তাঁর কাজ নিয়েও সেখানে আলোচনা হতো।’ (সাক্ষাৎকার তাং- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

শিল্পী গোলাম হোসেন ২০০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। গুণী-প্রচারবিমুখ এই শিল্পী শিল্পকলাকে ভালোবেসে এর চর্চা করে গেছেন আজীবন। পরিতাপের বিষয়, তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতি আমরা দিতে পারিনি। মরণোত্তর সম্মাননার বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (প্রতিষ্ঠাতা প্রভাষক), রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়।