পাথর সময়

আপডেট: এপ্রিল ১৭, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

কেএম আব্দুস সালাম:


বুকের উপরে সময় পাথর হয়ে চেপে বসে থাকে, কিছুতেই টেনে নামাতে পারি না । সময় স্মৃতি হয়ে জমে থাকে মনের গভীরে। ভার লাঘবের জন্য কখনো কখনো আমরা স্মৃতিচারণ করে হালকা হতে চাই। একেই আমরা নস্টালজিয়া বলি।

পয়লা বৈশাখ ১৪৩১, রবিবার। সকালে ঘুম থেকে জেগে মোবাইল খুলে দেখি অনেক শুভেচ্ছা শুভার্থীরা জানাচ্ছেন আমাকে। আমিও শুভেচ্ছা বিনিময় করছি। ডাইনিং টেবিলে
বসে চমকে উঠি গৃহিণীর সারপ্রাইজ দেখে। পান্তাভাতের সাথে ইলিশ , হরেক রকমের ভর্তা-ভাজি । তারও চেয়ে সারপ্রাইজ হই মাটির তৈজসপত্র দেখে। মাটির প্লেট, গ্লাস, এমনকি চায়ের কাপও মাটির তৈরি। চমৎকার কারুকাজ করা । আমি এগুলোর নকশা দেখতে দেখতে ফিরে যাই আমার কৈশোরে।

নিভৃত পল্লীগ্রাম। বৈশাখের তপ্তদুপুরে বাইরে বেরুনো নিষেধ। মাটির ঘরে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত বসে বসে অংক করতে হবে এটাই পিতার আদেশ। এমনি কোনো কোনো দুপুরে শুনতে পাই কুমোরের সূর করা ডাক, “ হাড়ি পাতিল নিবেন—-, মাটির হাড়ি- —পাতিল”। আমি জানালা দিয়ে দেখি, তপ্ত দুপুরে খালি গায়ে ঘর্মাক্ত কুমোর তার তৈরী তৈজস মাটির হাড়ি পাতিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করছে। চরম দারিদ্রতার ছাপ তার শরীরে। অর্ধ- উদোম শরীর, কাঁধে অধিক ওজনের ভার, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ। এভাবেই ডেকে ডেকে যায় সে, ‘হাড়ি-পাতিল নিবেন, মাটির হাড়ি-পাতিল’।

তার ডাকে সাড়া দেয় অলস দুপুরে বিশ্রামে থাকা গৃহিণীরা। পৌষ- মাঘ মাসে জমিয়ে রাখা চিটা ধান দিয়ে কিনে রাখে মাটির হাড়ি- পাতিল। চিটা ধান , অর্ধেক মৃত , অর্ধেক সতেজ ধান। সেই ধান নিয়ে দরিদ্র কুমোর বটগাছের ছায়ায় বৈশাখের বাতাসে ওড়ায়। চিটা গুলো ফেলে রেখে সতেজটুকু সযত্নে রেখে দেয় তার শূন্য ডালায়। তারপর কোনো দয়াবতী গৃহিণীর দেয়া গুড়- মুড়ি আর পানি খেয়ে যাত্রা করে তার গ্রামের দিকে । সেখানে অপেক্ষায় আছে তার ক্ষুধার্ত স্ত্রী আর সন্তানেরা।

সেই দরিদ্র কুমোর, সেই তপ্ত দুপুর, সেই মানুষ ঠকানো চিটা ধান পাথরের ওজন নিয়ে চেপে আছে স্মৃতিতে আমার। আমি যখন এই স্মৃতিচারণ করছি তখন কেবলই মনে হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা হয়তো কুমোর, চিটা ধান এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত নয়। হায় সময়, পাথর সময় আমার।