জলদস্যুতা এবং সোমালিয়া

আপডেট: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ


মজিবুর রহমান:


সোমালিয় জলদস্যুরা ভারতীয় মহাসাগর থেকে ১২ মার্চ ২০২৪ বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এম,ভি আব্দুল্লাহ-কে হাইজ্যাক করে। বাণিজ্যিক জাহাজটি মোজাম্বিকের মাফতো থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিযে দুবাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। জাহাজটিতে মোট ২৩ জন নাবিক রয়েছে। নাবিকরা দেশ এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ৩১ দিন সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থেকে অবশেষে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় রাত্রি ৩:০৮ মিনিটে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে জাহাজটি আরব আমিরাতের দিকে রওনা হয়েছে। অধিক নিরাপত্তার জন্য জাহাজটি কাটাতারের বেড়ার আওতায় আনা হয়েছে।

সোমালি জলদস্যুতা হাতে বাংলাদেশি জাহাজ এম,ভি আব্দুল্লাহ-ই প্রথম জিম্মি হয়েছে তা নয়, এর আগে ২০১০ সালে আমরা বাংলাদেশি জাহাজ ‘জাহান মনি’-কে তাদের হাতে জিম্মি হতে দেখেছি। ‘জাহান মনি’-তে ২৫ জন নাবিক ছিল। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে জাহাজটি মুক্ত করে আনা হয়েছিল। তবে বর্তমানে সুখের খবর এই যে, জলদস্যুরা আমাদের নাবিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। এমনকি তারা জিম্মিদের সোমালি ছাগলের তেহারি খাইয়েছে। ২০১০ সালে জিম্মি হওয়া ‘জাহান মনি’-র নাবিক আব্দুল্লাহ বলেন, মুক্তিপণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে জলদস্যুরা ফুরফুরে মেজাজে থাকে এবং জিম্মিদের প্রতি ভালো আচরণ করে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্স অপারেশন আটলান্ডা এবং ভারতীয় নৌবাহিনীরা হার্ড লাইনে গিয়ে জাহাজটি উদ্ধারের প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ তা নাকোচ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার এবং জাহাজ কোম্পানির কথা পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৌশলে এম.ভি আব্দুল্লাহ জাহাজ এবং তার নাবিকদের উদ্ধারে কৌশল নেয়ায় তা কাজে লাগিয়েছে এবং জাহাজটি উদ্ধার হয়েছে।

বাদশা আওরঙ্গজেবের আমলেও জলদস্যুর কথা জানা যায়। আওরঙ্গজেব জলদস্যুদের নির্মূল করতে সেনাপতির প্রতি কড়া নির্দেশ দেন। সেনাপতি শায়েস্তা খাঁ বাদশার কথা বাস্তবায়নে কঠোর ভূমিকা পালন করে জলদস্যুর প্রধান সেবাস্তিয়ান গঞ্জানেসকে ধরে ফেলে। আধুনিক সভ্য সমাজে এসে আমরা ইতিহাসের সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। তৎকালীন জলদস্যুরা নৌকা, তীরধনু, তলোয়ার ব্যবহার করলেও আজকে আধুনিক যুগের আধুনিক জলদস্যুদের হাতে আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম, স্টিলের পাতের শক্তি চালিত ইঞ্জিনের নৌকা, আধুনিক জিপিএস প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং রাডারের চোখ ফাঁকি দেওয়ার মতো প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের জনগণ জলদস্যুতাকে অবৈধ পন্থা মনে করলেও সোমালি জলদস্যুরা তা মনে করে না।

তারা মনে করে তারা এটি বৈধ্যভাবেই করছে। সোমালিয়রা রীতিমত জলদস্যু হবারই স্বপ্ন দেখে। তাদের বৈধতার পেছনে যুক্তি হলো, আমরা পৃথিবীর অতি দারিদ্রতম দেশ। আমাদের দেশের মাটি পাথুরে, নেহায়েতই উর্বর নয়। আমরা সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু আমাদের তা করতে দেয়া হলো না। বিদেশি জাহাজ এসে অবৈধভাবে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় সমুদ্রের মাছ কমে গেছে। আমরা আর প্রয়োজনীয় জলদস্যুতা মাছ পাচ্ছি না। তাছাড়া বিদেশি জাহাজের বর্জ্য ফেলায় আমাদের উপকূল দুষণীয় হয়ে গেছে।

উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দারিদ্র পীড়িত দেশ সোমালিয়া পৃথিবীর দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাষ্ট্র। দেশটির দারিদ্রের প্রধান কারণ গৃহযুদ্ধ। ১৯৮৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলছে। এই গৃহযুদ্ধে অর্থায়নে এবং খাদ্যের জন্য তারা এডেন উপসাগরে জলদস্যুতা শুরু করে। দেশের মাটি পাথুরে এবং অনুর্বর হওয়ায তাদের খাদ্যের যোগান হয় না। ফলে তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি তারা মুসলিম রাষ্ট্রের জনগণ। ইসলাম ধর্ম কোনো ভাবেই এই পথকে সমর্থন করে না।

ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়া নামক দেশটির জন্ম হয়। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পর নৈরাজ্যের মাধ্য পড়ে দেশটি। তারপরের দুই দশকে সোমালিয়ায় কার্যকর কোনো সরকারই ছিলনা। টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমালিয়ার এই করুণ পরিণতির সুযোগ কেবল তাদের জলদস্যুরাই নেয়নি, নিয়েছে অনেক দেশই।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক অবৈধ কোম্পনিগুলো সোমালিয় জলদস্যুতা উপকূল রেখা থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হলুদ টুনা মাছ আহরণ করে এবং জাহাজ চলাচলে নিঃসৃত বর্জ্যে উপকুল দূষিত হয়ে গেছে। এভাবে সি-ফুড কমতে থাকলে জেলে পাড়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। প্রথমে তারা উপকূলে ঘুরে বেড়ানো জাহাজগুলোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে দিতে একসময় তারা জলদস্যুতার দিকে পা বাড়ায়। তারা উপলব্ধি করে, মাছ শিকারের চেয়ে জলদস্যুতার আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই সে পথটাকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নেয়।

২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তিত্ব ১৪ টি জাহাজ তারা ছিনতাই করেছে। এই ছিনতাই পেশার পেছনে জেলে, যুবক শ্রেণি এমনকি সেনাবাহিনীর কিছু লোকও জড়িত বলে জানা যায়। তাছাড়া সোমালিয়ান সাধারণ জনগণেরও কিছু অংশের সমর্থন রয়েছে মর্মে জানা যায়। এক্ষেত্রে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলের সমুদ্র নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সোমালিয়ার জলদস্যুতা মোবাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই তাই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। সোমালি মৎস্যজীবীদের দাবি তাদের উপকূল তাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হোক।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, বখতিয়ারপুর ডিগ্রী কলেজ