শুভ বৈশাখ : শুভ নববর্ষ ১৪৩১

আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪, ৭:২৫ অপরাহ্ণ

শুভ বৈশাখ : শুভ নববর্ষ ১৪৩১

মজিবুর রহমান:


ইংরেজ শাসন আমলে এদেশে খ্রিস্টীয় সনের প্রচলন শুরু হয় এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কাজে সনটির ব্যবহার শুরু হয়। হযরত ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু এ খ্রিস্ট সনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের আগের সময়কে বলা হয় Before Christ বা B.C বাংলায় খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। আর তাঁর মৃত্যুর পরের সময়কে বলা হয় After Death বা A.D বাংলায় খ্রিস্টাব্দ। অনেকে এ তারিখকে ইংরেজি সন বলে থাকেন। আমাদের এ ভ্রান্তিটা ইংরেজদের শাসনের ফলেই এসেছে। এটি বস্তুত গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির তাই তাকে খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করাই সমীচীন।

বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স ৪০ বছর পূর্ণ হলে অর্থাৎ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নব্যুয়তপ্রাপ্ত হন। তিনি ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মক্কার কুরাইশদের হাতে দারুণলভাবে বাধাগ্রস্ত এবং অত্যাচারিত হন। বাধ্য হয়ে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের তারিখটি ছিল ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক চান্দ্র বর্ষের ১২ই রবিউল আওয়াল। এ ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলাম জগতের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সন গণনার ফরমান জারি করেন। প্রচলিত আরবি বা হিজরি বছর চান্দ্র মাসের হিসেবে গণনা করা হয়। চান্দ্র মাসের প্রথম মাস মহররম, গণনার সুবিধার জন্য সমন্বয় করতে গিয়ে হযরত ওমর (রা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ২০ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে ১৬ জুলাই থেকে হিজরি সন গণনা শুরু করেন। খ্রিস্ট সন হিজরিে সন জানা থাকলে বাংলা সনের প্রবর্তনের ইতিহাস জানা সহজ হয় বলে ধান ভানতে শীবের গীত চলে আসল।

যা কিছু নতুন তাকে ভালোবাসি আমরা। হোক নবজাতক শিশু, ফুল, পাখি, কিংবা প্রভাতের নবীন সূর্য। নবীন বর্ষ নবীন দুর্বাঘাষের মতো নবীন জীবন ও স্বপ্ন দেখায়। এল নবীন বর্ষ, নবীন বাংলা বর্ষ ১৪৩১। সমস্ত আকাশ-বাতাস ফুলে আনন্দে, সৌরভে মধুময়ে ভরে গেছে। সেই কবে হিজরি ৯৬৩-তে স¤্রাট আকবর ফসলী সন চালু করলে সেই হিজরির অনুকরণে আমাদের হয়ে গেল বাংলা নববর্ষ। তখন ছিল খ্রিস্টাব্দ ১৫৫৬। কিন্তু আমাদের বাংলা সন আর খ্রিস্টাব্দ সনের মধ্যে মস্ত বিজ্ঞান সচেতন যুক্তি আছে। হিজরি সনের সংখ্যাটি দিয়ে চালু হয়েছে সত্যি কিন্তু বাংলা সন সৌরনীতির ধারণা এবং বিশ্বাসকে গ্রহণ করে। যেমন ইউরোপীয় সন অর্থাৎ গ্রিগরি সালের হিসাব সৌরনীতির হিসাব মেনে চলে। ফলে প্রতি বছর নববর্ষ আসে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ এপ্রিলের চৌদ্দ কিংবা পনের তারিখে অবশ্যই হবে পহেলা নববর্ষ এবং বাংলা সন হবে নির্দিষ্ট ৩৬৫ দিনে। অর্থাৎ পৃথিবী ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডে নিজ কক্ষপথ ঘুরে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। আমরা নব-উদ্যোমে পহেলা বৈশাখ পাই, নববর্ষ পাই।

কিন্তু চান্দ্ররাত্রি ধরে উপগ্রহ চাঁদের পৃথিবী প্রদক্ষিণে সময় লাগে ৩৫৪ দিন। চন্দ্রারীতি অনুসরণ করে ১১ দিন এগিয়ে গেলে ৬ ঋতুর সমাহার ল-ভঙ্গ হয়ে যেতো। আমাদের জীবন আচরণের সঙ্গে সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্রের বড় প্রভাব। আমাদের সামাজিক আর ব্যবহারিক জীবনে বাংলা মাস, ধর্মীয় জীবনে হিজরি সন আর রাষ্ট্রীয় কর্মে খ্রিস্টীয় সন কোনো বিরোধ নেই আমাদের। কিন্তু রাজনীতির টাউটবাজরা, বর্ণের মৌলবাদীরা এবং সামাজিক দ্বন্দ্ববাজরা আমাদের জীবনকে কলুষিত করে দেয়, কৌশলে বিভেদ ছড়িয়ে দেয়। বৃটিশরা দিয়েছে, পাকিস্তানিররা দিয়েছে, এখন দিচ্ছে আমাদেরই লোক তাদের অনুসারীরা। তবে বাংলা আর বাঙালি অভেদ্য একটি জীবনসত্তা। এখানে ভেদ টেনে বিচ্ছেদ করা যাবে না। বাঙালিরা শেষমেষ একই ছাতার তলে দাঁড়াবেই তাতে কোনো সংশয় নেই। হে বাংলা নববর্ষ তোমার আগমনে অফুরান হয়ে উঠুক বাংলার জীবন।

পৃথিবীতে যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে নিজেকে চেনা অর্থাৎ স্বদেশকে চেনা মনে হয় সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই ধুলোমাটি, সারাদিন পাখির ডাকা, ছায়াঢাকা পল্লীবাট। বাংলার গণনায়ক গোপাল, মননায়ক চৈতন্য, চেতনা নায়ক রবীন্দ্রনাথ, আব্দুল হাকিম, লালন ফকির এবং বঙ্গবন্ধুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এদেশকে লালন করব আমরাই, পালনও করব আমরাই। স্বদেশিকতা, সাংস্কৃতিকতার ভাষায় আমরাই উজ্জীবিত হবো সর্বদায় এবং আমাদের আগামী প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়েই। সে ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে এবং করব। নববর্ষের উৎসব আজ ছায়ানটের, পশ্চিম বাংলার, পূর্ব ভারতের, ৭০টি দেশের এবং গোটা বিশ্বের।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, বখতিয়ারপুর ডিগ্রি কলেজ