রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কলে ছাঁটা বিদ্যা

আপডেট: মে ৮, ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ
আব্দুল হামিদ খান:


রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তিন কি চার। তখন তাঁর ইস্কুলে যাবার জন্য সে কী কান্না। কান্নার চোটে স্কুলে ভর্তি করা হলো রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু দিনকতক যেতেই ইস্কুলে যাবার ইচ্ছা হাওয়া হয়ে গেল একেবারেই। তিনি দেখলেন কোন ছাত্র পড়া না বলতে পারলেই তাঁকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে তার দু’হাতের উপর বেশ কিছু স্লেট জড়ো করে চাপিয়ে দেয়া হয়। এ থেকেই শিশু রবীন্দ্রনাথ আর স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরেন না।

এরপর পাঁচ-ছয় বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে ভর্তি করা হলো ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট পাঠশালায়। ভাল লাগেনি এখানকার সাহেবী চালচলনও। সমবেত স্বরে রোজ সকালে ইংরেজি গানে গলা মেলানো পছন্দ না তার। সময় ধরে ধরে পড়ালেখা ও শরীরচর্চা চলত। ভোরে উঠে এক কানা পালোয়ানের কাছে ল্যাঙ্গোট পড়ে ধুলোমাটি মেখে কুস্তি লড়তে হতো। কুস্তি লড়ে এসে দেখতেন মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র বসে আছেন মানুষের হাড় চেনাবার বিদ্যা শেখানোর জন্য। দেয়ালে ঝুলতো আস্ত একটা কঙ্কাল। সকাল সাতটা বাজতেই হ্যাংলা রোগা শরীর নিয়ে হাজির হতেন নীল কমল মাস্টার। বোঝাতেন পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি। সাহিত্যের মধ্যে ছিল সীতার বনবাস, মেঘনাদবধ কাব্য। সঙ্গে ছিল প্রাকৃত বিজ্ঞান। এরপর সকাল নয়টা।
কালো গোবিন্দ কাঁধে হলদে রংয়ের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে তাঁকে নিয়ে যেত স্নান করাতে। সাড়ে ন’টা বাজতেই রোজকার বরাদ্দ ডাল-ভাত মাছের ঝোলের বাঁধা ভোজ। দশটার ঘন্টা বাজে। দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত ইস্কুল। সাড়ে চারটের পর ইস্কুল থেকে ফিরে এসে পড়েন ছবি আঁকার মাষ্টার হাতে। সন্ধে বেলায় ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে রেড়ির তেলের বাতি। অঘোর মাষ্টারের কাছে শুরু হয় ইংরেজি পড়া।
এমনই কঠিন ছকে বাঁধা জীবন ছিল তার। যা একদম তাঁর অপছন্দ। প্রাণহীন ও আনন্দহীন, যান্ত্রিক সে শিক্ষার বিড়ম্বনা তাঁর আজীবন মনোযন্ত্রনার কারণ হয়েছিল। এক যুগেই তিনি স্কুলের পাঠ চুকিয়েছিলেন। তারপরেই স্কুল থেকে পলায়ন। এরপর রবীন্দ্রনাথ আর কখনও স্কুলমুখো হননি। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ১৮৯৯ সালে যখন নিজ পুত্র কন্যার শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, তখন তিনি ফের ইংরেজি বিদ্যার দ্বারস্থ হন। শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে স্থাপন করেন গৃহবিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের প্রাণহীনতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধবী লতার চিঠিতে। তিনি লেখেন- ৪টি ঘন্টা গৎ খড়ৎিবহপব এর কাছে পড়ে দিন কাটানো শক্ত হয়ে ওঠে।
শৈশব ও কৈশোরের ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজের পড়ার অভিজ্ঞতা এবং যৌবনে পড়ানোর উদ্যোগ দু’টোই রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। এ ব্যবস্থায় যান্ত্রিকতা ও প্রাণহীনতা তিনি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই ভারতবর্ষে দেশজ শিক্ষাব্যবস্থাকে হটিয়ে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়। এ ব্যবস্থা ভারতবর্ষের মঙ্গলের জন্য করা হয়নি, হয়েছিল বৃটিশ সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসের দিকে একটুখানি তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ বৃটিশ রাজের কাছ থেকে নবায়ন করতে গেলে সেখান থেকে শর্ত দেয়া হয় ভারতবর্ষের শিক্ষার দায়িত্ব কোম্পানীকে গ্রহণ করতে হবে। এই খাতে কোম্পানীকে কমপক্ষে একলক্ষ টাকা ব্যয় করতে হবে।
সে হিসাবে কোম্পানী ১৮১৩ সালে এ অঞ্চলে শিক্ষার জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু সমস্যা তৈরী হয় এ অর্থ ব্যয় করার খাত নিয়ে। ভারতবর্ষে তখন দেশজ শিক্ষাধারা সমূহ সচল, ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার সবে সূচনা ঘটেছে। এ অবস্থায় বরাদ্দ অর্থ কোন্ ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হবে এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। ফলে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত এ অর্থ থেকে এক টাকাও ব্যয় করা যায়নি। ১৮২৪ সালে গঠিত হয় কমিটি ফর পাবলিক ইনস্ট্রাকশন। তাদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দেয়। এ সময় ভারতবর্ষের ভাইসরয় হয়ে আসেন লর্ড বেন্টিঙ্ক। ভারত বর্ষের শিক্ষার বাস্তব অবস্থা বোঝার জন্য তিনি উইলিয়াম অ্যাডামকে শিক্ষা জরিপের দায়িত্ব দেন। উইলিয়াম অ্যাডাম জরিপ করে দুটি রিপোর্ট জমা দেন ১৮৩৫ ও ১৮৩৮ সালে।
অ্যাডাম তার জরিপে বলেন, শুধু বাংলা ও বিহার অঞ্চলেই শিক্ষার জন্য দেশজ শিক্ষাধারার এক লাখ বিদ্যালয় রয়েছে। অর্থাৎ তখন টোল, চতুষ্পঠি, মক্তব-মাদ্রাসা ও পাঠশালা মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। এ সময় গভর্নর হয়ে আসেন লর্ড মেকলে। মেকলে ভারতীয়দের জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে নিদারুন উন্নাসিক ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, সারা প্রাচ্যের জ্ঞান ইউরোপের একটি বইয়ের তাকের সমান। তিনি তখন শিক্ষায় তার বিখ্যাত চুইয়ে পড়া নীতি পেশ করেন। তিনি বলেন, ভারতবর্ষের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন এক শ্রেণি তৈরী করা, যারা শুধু আকৃতিতে হবে ভারতীয়, কিন্তু মন মানসিকতায় হবে ইউরোপীয়। শিক্ষার সুযোগে দেয়া হবে উচ্চতর শ্রেণীকে। এদের মাধ্যমে শিক্ষা নীচ শ্রেনীর মধ্যে চুঁইয়ে পড়বে। লর্ড বেন্টিঙ্ক শিক্ষায় অ্যাডামের পর্যবেক্ষনকে গুরুত্ব না দিয়ে মেকলের নীতি গ্রহণ করেন। শিক্ষার মাধ্যম হয় ইংরেজী। অনুসৃত হতে থাকে পাশ্চাত্য বিদ্যা। হারিয়ে যেতে থাকে দেশজ ধারা। পাঠশালা হয়ে ওঠে স্কুল। লন্ডন ইউনিভার্সিটি মডেলে প্রতিষ্ঠিত হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঘটে ঔপনিবেশিকরণ। বঙ্কিমচন্দ্র পরে দুঃখ করে বলেছিলেন শিক্ষিতে অশিক্ষিতের হৃদয় বুঝে না।
রবীন্দ্রনাথ এ শিক্ষার অন্তঃসারশূণ্যতা শুরুতেই ধরতে পেরেছিলেন। তাঁর কাছে শৈশবেই মনে হয়েছে এ শিক্ষা প্রাণহীন, যান্ত্রিক। তিনি একে বলেছিলেন কলে ছাঁটা বিদ্যা। ফলে তিনি জীবনের শুরুতেই এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। মেকলে শিক্ষা পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের কেরানী তৈরী করা, যারা হবে স্বসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার যে শিক্ষাব্যবস্থা ছাঁচে গড়া কেরানি তৈরী করে, তাও ভীষণ বৃত্তাবত্ত আর যান্ত্রিক। রবীন্দ্রনাথ এ শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র কৌতূহল পূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন- ‘ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দেবার কল। মাষ্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটায় ঘন্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাষ্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাষ্টার কলও তখন মুখ বন্ধ করেন। ছাত্ররা দুই পাতা কলেছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়।”
রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব জ্ঞানভান্ডার থেকে জ্ঞান আহরণের বিপক্ষে ছিলেন না, বরং পক্ষেই ছিলেন। তাঁর আপত্তি ছিল নিজেদের না জানার ব্যাপারটায়। রবীন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে। কবিগুরু তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন এ ব্যবস্থা বড় যান্ত্রিক, আনন্দহীন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিরোধিতা করেই বসে থাকেননি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর প্রতিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার  নজির। শন্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেন আশ্রম বিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী। শিক্ষায় শান্তিনিকেতনের গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল নামেই রবি নন, বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি সত্যিই রবি। বাঙালির এই কবি তাঁর অভূতপূর্ব প্রতিভা, মহিমাময় সৃজনীশক্তি ও নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। শ্বেত শুভ্র শুশ্রুশামন্ডিত গৌরবর্ণের দীর্ঘদেহী পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ আর মৃত্যু ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট