অবন্তিকার আত্মহত্যা ও কিছু কথা

আপডেট: এপ্রিল ৬, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজা সাদাফ অবন্তিকা অনেক দুঃখে অভিমানে আত্মহত্যা করেন। তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান কর্তৃক যৌন হয়রানির বিচার চাইতে অবন্তিকা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ জানান। বিপরীতে পান দুর্ব্যবহার, তবুও বিচার পাওয়ার আশায় দীর্ঘ ৪ মাস অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু পাননি। এটা তার আত্মসম্মনে ভীষণভাবে আঘাত করে এবং অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

অবন্তিকার আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে কিছু বুদ্ধিজীবী বলেছেন, আত্মহত্যা করে অবন্তিকা কী পেলো? বরং বেঁচে থেকে লড়াই করলে হয়তো প্রতিকার পেতে পারতো। প্রশ্ন ওই বুদ্ধিজীবীদের কাছে অবন্তিকা বেঁচে থেকে লড়াই চালালে আপনারা তথা বর্তমান সমাজ তাকে পতিত মেয়ে বলে ভাবতেন না? এমন ঘটনার শিকার অনেক মেয়ে আছেন তারা কি মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে আছেন? তাদের সাথে কি স্বাভাবিক ব্যবহার করা হয়?

লড়াই চালাতে গিয়ে অবন্তিকা পুনরায় যৌন হয়রানির শিকার হতেন বিপক্ষ আইনজীবীর কাছে প্রকাশ্য আদালতে। এই দ্বিতীয় দফা অপমানিত হতে চাননি অবন্তিকা। এই অপমান ও সামাজিক কুচর্চা থেকে বাঁচতেই তো তিনি প্রক্টরের কাছে গিয়েছিলেন বিচার চাইতে যেন বিষয়টি চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, সামাজিক কুচর্চায় পরিণত না হয়। তাই সমাজকে প্রথমে এই কুচর্চা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অবন্তিকা আত্মহত্যা করার পূর্বে সুইসাইডাল নোট দিয়ে অন্ততপক্ষে অপরাধীদের চিহ্নিত করে গেছেন সমাজের কাছে, নিরব প্রতিবাদ করে গেছেন। সমাজ যেন এর বিচার করে। তাইতো সমাজ নড়ে চড়ে বসেছে, গণমাধ্যম তৎপর হয়েছে, অভিযুক্তরা কারান্তরীণ হয়েছে।

অবন্তিকা যার কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিলেন তিনি তো শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের যে কোনো সমস্যার বিচার করার এখতিয়ার রাখেন। তিনি অভিযুক্তকে ডেকে শাসন-গর্জন করতে পারতেন অথবা অন্য কোনো পরামর্শ দিতে পারতেন। এতে হয়তো অবন্তিকাকে আত্মহননের পথে যেতে হতো না। কিন্তু দীর্ঘ ১২০ দিন অবন্তিকা প্রতিনয়ত মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন ও শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই বিচারক বিচারকেই অস্বীকৃতি জানালেন। সেটাই অবন্তিকার জন্য কাল হলো।

আইনজ্ঞরা বলেন Justice delayed is Justice denied. সেটাই হয়েছে অবন্তিকার ক্ষেত্রে। অনেকে বলতে পারেন ১২০ দিনকে কি বিলম্বিত সময় বলা যায়। অবশ্যই বলা যায়। বিলম্ব করার পাশাপাশি তিনি বিচারকেই অস্বীকার করেছেন। কারণ, বিষয়টা ছিল খুবই সংবেদনশীল ও আত্মসম্মানের। অবন্তিকার আত্মহত্যা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিমের যৌন হয়রানির তদন্ত ত্বরান্বিত করেছে। তদন্তে ঘটনা সত্য প্রমাণ হওয়ায় প্রভাষক আবু সাহেদ ইমনকে সাময়িক বহিস্কার এবং শিক্ষার্থীকে এ ব্যাপারে অসহযোগিতা করার জন্য ওই বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর জুনায়েদ হালিমকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু ইতোমধ্যে মিমের যা ক্ষতি করার তা ওই দুই শিক্ষক সম্পন্ন করেছেন। মিমকে দুশ্চরিত্র বলে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন, তাকে ইনকোর্স পরীক্ষায় ফেল করিয়েছেন, পুরো দুটি বছর তাকে প্রতি পদে পদে চূড়ান্ত হয়রানি করেছেন। এই বিলম্বিকরণের ফল অবন্তিকার মত হতে পারতো। কিন্তু মিম তো এখন জীবন্মৃত।

এইতো কয়েকদিন আগে বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী সাদী মহম্মদ আত্মহত্যা করে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তার একজন গুণমুগ্ধ ও আপনজন বলেন, সাদী ভাইয়ের মধ্যে একটা অজানা হতাশা করছিল। তার মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। হয়তো ভাবতেন তার যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না।

আসলে তার অর্জন ছিল আকাশছোয়া। সেটা কেউ সহজে উপলদ্ধি করতে পারবেন না। আমরা যদি এভাবে ধরি যে একজন পুরূষ শিল্পী যেভাবে আমাদের সংগীত জগতকে আলোড়িত করেছিল সেটা কিন্তু একটা ঈর্ষনীয় একটা জায়গা। সেখান থেকে যে কোনো ফিডব্যাক আসেনি তা নয়, এসেছে তবে সেটা হয়তো সঠিক প্রাপ্তি ছিল না। এ কথাগুলোর মধ্যে নিহিত আছে যে এ সমাজের কাছে তার বিশেষ পাওনা ছিল। কিন্তু সমাজ তার সঠিক বিচার করেনি।

তাই ক্ষোভে দুঃখে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। অবন্তিকার মত তিনি সুইসাইডাল নোট দিয়ে যাননি বটে কিন্তু তার আত্মহত্যা অবশ্যই কিছু বার্তা বহন করে। এখানেও Justice delayed is Justice denied phrase টি যথার্থ। সময়ের প্রাপ্তি সময়ে না হলে হতাশা আসে, ক্ষোভ হয়, আর আত্মহননের মতই ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি একটি চলমান মামলার খবর এসেছে একটি জাতীয় দৈনিকে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৬৯ সালে একটি জমি (২,৭৫ একর) যার দাম সর্বোচ্চ ২/৩ হাজার টাকা ছিল। এখন তার মুল্য ১৬ কোটি টাকা। এনিয়ে মামলা চলছে ৫৫ বছর ধরে। বাদি বিবাদি মারা গেছে। উত্তরাধিকারী হিসেবে যারা মামলা চালাচ্ছেন তারাও এখন প্রবীণ। কিন্তু মামলার নিস্পত্তি হয়নি।

নারায়ণগঞ্জের চন্দ্রবর্দী মৌজায় অবস্থিত এ জমির মূল মালিক ছিলেন দুখাই চন্দ্র পাল। তিনি ওই জমি ২ হাজার টাকা মূল্য ধরে একজনের সাথে বায়না করেন এবং কিছুদিন পরে এক হাজার টাকা বেশি পাওয়ার লোভে আর একজনের সাথে ৩ হাজার টাকা মূল্য ধরে বায়না করেন ও রেজিস্ট্রি দেন। ফলে মামলা শুরু হয়। দুখাইচন্দ্র পাল একই জমি দুজনের কাছে বিক্রি করে প্রতারণা করেও আদালতের নজরে পড়েনি আর প্রতারিত ক্রেতা দুই পক্ষ নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত আপিল রিভিশন মামলা লড়ছে ৫৫ বছর ধরে।

বর্তমানে দু’পক্ষই ভাবছেন তাদের উত্তরাধিকারদের জমি বুঝিয়ে দিতে পারবেন তো। সম্প্রতি একটি হত্যাকাণ্ডের রায় হয়েছে দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরি এলাকার গৃহবধু সগিরা মোর্শেদ পারিবারিক শত্রুতার জের ধরে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে রাস্তার মধ্যে খুন হন ১৯৮৯ সালে। তখন তিনি তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে সারাহাত সালমাকে ভিখারুন্নিসা নুন স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিলেন সেই পথে। ওই মেয়েটির বয়স এখন প্রায় ৪২ বছর।

সেই মেয়ে এই রায়ের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলেছেন এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের খালাস দেওয়া হয়েছে কেন। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি। তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। অন্য একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী এবং নাট্যকর্মী সোহাগি জাহান ২০১৬ সালে ২০ মার্চ সেনানিবাস এলাকায় খুন করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ৮ বছর পার হয়ে গেছে ,ইতোমধ্যে। ৪ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে কিন্তু মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এখন পর্যন্ত খুনিদেরই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তনুর পিতা ইয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, তার অর্থ সম্পদ নেই বলেই মামলার এই দুরবস্থা। এজন্য তিনি প্রাধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চান। তনুর পিতা মাতা আজ অসহায় দিন যাপন করছেন। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। এগুলো সবই justice delayed is justice denied এর ফসল।
আমরা দেখি এ দেশে বিরোধী দলকে ঘায়েল করার জন্য কালক্ষেপণ হয় না। মুহূর্তের মধ্যে তদন্ত হয়ে যায়, সাক্ষী প্রমাণের অভাব হয় না। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা খুব তৎপর।

অন্যদিকে দেখি এসএম কিবরিয়ার বিচার, উদীচী ট্রাজেডির বিচার, সাগর-রুনীর হত্যার বিচার, ত্বকি হত্যার বিচার, মুনিয়া হত্যার বিচার, পিলখানা হত্যার বিচার সহ অনেক মামলার বিচার পড়ে আছে। সাগর রুনীর হত্যার বিচারতো দূরের কথা শতাধিকবার দিন নিয়েও চার্জশিটই দেওয়া হয় না। মামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা আর কতদিন অপেক্ষা করবে তার ঠিকানা নেই।

এখন ক্ষতিগ্রস্তরা আর আশায় আশায় আশান্বিত হয় না, আশায় আশায় দিন গুণে না বরং তাদের মন আশংকার দোলায় দোলে। কী হবে, কিবা হতে পারে, আদৌ বিচার হবে কি ভেবে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বিচার সংক্রান্ত কর্মকর্তারা বলেন, সাক্ষী প্রমাণের অভাবে বিচার হয় না, বেঞ্চ ও বারের সমন্বয় হয় না, বিভিন্ন অজুহাতে মামলার দিন পড়তেই থাকে, সময়মত চার্জশিট হয় না। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচারকদের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই মামলা নিস্পত্তিতে। সেটাই হতে পারে সাধারণ মানুষের জন্য ভরষার স্থল।
লেখক : সাংবাদিক