ফেলে আসা ইদ ফিরে দেখা

আপডেট: এপ্রিল ২, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির:দেশভাগের আগে ইদকে আমরা উৎসব হিসেবেই দেখেছি। প্রায় আধঅবছর ধরে ইদের আগে ছিলো আমাদের প্রতীক্ষা। বিশেষ করে তখন থেকেই এক আনা দুই আনা পয়সা জালিতে ভরে শোবার আগে একবার গুনতাম। কবে একটাকা হবে। দেশভাগের আগে একটাকা আর হয়নি। ‘তবু আনন্দ, তবু আনন্দ’ জাগতো। এটা ছিলো একধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়া। প্রতিবেশীদের পূজার আনন্দ দেখতে দেখতে আমরাও আনন্দ উপভোগে উৎসাহী হয়ে উঠতাম। সে আনন্দ কতখানি ঠুনকেভ, আজ প্রায় জীবন শেষে একটু একটু বুঝছি।

শীতের দিনে কাঁপতে কাঁপতে গোছল করে পুরাতন কাপড় ইসতিরি করেÑঅর্থাৎ পরিষ্কার করে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে- তা পরে চোখে সুরমা দিয়ে ছুটতাম ইদের মাঠে। নামাজের আয়োজন অপেক্ষা পাঁচ মিশেলি খাবারের দোকানের দিকে নজর থাকতো বেশি। অস্থায়ী দোকানে সেসব খাবার আর কী! ঐ যে টক কুলের গোলাকার আচার (এক পয়সা দামে) গুড়ের জিলাপি, গুড়ের পান তোয়া, তিলের খাজা, আর আকর্ষণীয় টাটকা ভাজা পাপড়। সাধারণ এসব মুখরোচক খাবার পাড়ায় পাওয়া যেত না। আমরা সে সব নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমরা দু’ভাই, তেমন সচ্ছলতা ছিল না পরিবারে।

ছোট ভাই একটা ছিল। তার আবদার কম ছিলো না। ইদের মাঠে যাবার সুযোগ তার হয়নি। তবে ওই জিনিসগুলোর প্রতি তার দুর্বলতা বেশি ছিল বলে ইদ ফেরত আমাদের হাতের দিকে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকতো। সমস্ত মান-অভিমান হেলায় তুচ্ছ করে সে চলে গেছে। রেখে গেছে আমাদের আনন্দ উপভোগের মাঝে বেদনার বহ্নিজালা। থাক, ভোলা গেল না এ জন্মে সে চলে যাওয়া। সকল অভবা অভিযোগের মধ্যে যে আনন্দ ছিল তা আর ফিরে আসেনি। অভাব চলে গেছে, নিয়ে গেছে আনন্দের উপচার।

একথা মানতে হবে ধর্মের কোনো অনুষ্ঠানই নিরঙ্কুষ নয়। ধর্মের অনুষ্ঠান হলো নিবেদনের। যে যেখানে আনন্দ পায়, সেটাই তার জন্য উপাদেয় আনন্দ হয়ে উঠে। আমরা ভেবে দেখতে পারি, পূর্ব পুরুষদের পরম্পরা। একদা আজকের মতো আড়ম্বরপূর্ণ ইদ ছিল না। ছিলো সাংস্কৃতিক আনন্দ উপভোগের দুটি পর্ব। বসন্ত আর শরৎকাল। মহানবী (সা.) মদীনায় এসে এর পরিবর্তন করলেন, দিলেন দুটি ইদের অনাড়ম্বর আয়োজন। সেই থেকে সমাজে অঙ্গীভূত হলো ইদ। কাপড়-চোপড়, খাওয়া-দাওয়ার বৈচিত্র তেমন ছিলো না। তবে পরিচ্ছন্ন হয়ে সুগন্ধি মেখে উন্মুক্ত মাঠে সবাই জমায়েত হওয়ার মধ্যে ইদ সমাপ্ত হতো। ইদের বিশাল ময়দানে ব্যক্তিগত জাতীয় মুক্তি কামনা করা হতো। এই যে আজকের আড়ম্বর, বোধকরি তখন ছিলো না।

মুসলমানরা ভারতে এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এবং সম্পদের লালসায়। অবশ্য তারও আগে আরব বণিকদের এদেশে আগমনের নজির আছে।
শাসন-শোষণ অপেক্ষা এদেশের প্রতি একটা মুক্ত ভালোবাসা জাগ্রত হওয়ায় তারা এদেশেই বসবাস শুরু করেছেন। লেখা বাহুল্য, প্রতিবেশী হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে আনন্দের পরিমাণ কম না। মুসলমানেরা পাশাপাশি অবস্থান করে নিজেদের আয়োজনে আনন্দ সৃষ্টি করে নতুন তৃপ্তি পেতে চেয়েছে। তবে একটা বিষয় মুসলমানদের মধ্যে সমানভাবে প্রচলিত ছিলো, চোখে সুরমা দেয়া। আমাদের পোল্লাডাঙ্গার পশ্চিমে মিয়ার বাগান ছিলো অনেক বড়। এখানে এখন বাড়ির জঙ্গল।

বাগানের পশ্চিমে একটু খালি জায়গায় হতো ইদের নামাজ। এখনো হয়। চারপাশে একাধিক গ্রাম। তাই সব পাড়াতেই পৃথক ইদগাহ ছিলো। কারণ ধর্মীয় আচার-আচরণের বোধে পার্থক্য। এখনো আছে।

দেশভাগের আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহরে কোনো ইদগাহ ছিলো না। জনৈক মহকুমা প্রশাসক আব্দুর রাজ্জাক চুরিআল পাড়ার পাশে পরিত্যক্ত আমবাগানে ইদের নামাজের ব্যবস্থা করেন। তবে আমাদের পোল্লাডাঙ্গা-আজাইপুর ইদগাহটি কেবল বৃহৎ নয়, দেখার মত সৌষ্টবও ছিলো। বাগানের চারপাশে বসতবাড়ি। নামাজের জন্য মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে মাথায় টুপি পরে বেরিয়ে আসছেন। আর বাড়ির মহিলারা সারবেঁধে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে আনন্দ উপভোগ করছেন। সবমিলিয়ে দু-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ইদ আয়োজন শেষ হয়ে যেতো। বাড়ি এসে যে যার মতো বিশ্রম্ভালাপের মধ্যে মশগুল হতো। অবশ্য ফেরার পথে কবরস্থানে কেউ দোয়া করতে ভুলতেন না। আমাদের পাড়ায় সরকারি বেসরকারি কর্মচারি তেমন ছিলো না বললেই চলে। যদিও দিনটি ছিল ছুটির। শহুরে মানুষ সে ছুটির আমেজ উপলব্ধি করতো।

শহরে ঘোরার জায়গা ছিলো কদমতলার ঘাট। তেমন পারাপারের মানুষ নেই। আমরা ছেলে-ছোকরারাই ঘাটে গিয়ে সাধারণ খেলা খেলে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতাম। এই ছিলো আমাদের দেশভাগের সময়ের ইদ। তিরাশি বছর পার করে এখন ইদের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি যেন তেমনটিই রয়ে গেছি। আর বদল হবে না এ জন্মে। সে আশাও করি না- সে যে দুরাশা।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ