প্রতিবাদমুখর রাজশাহীর সাংবাদিকরা

আপডেট: মার্চ ১৯, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:১৯ মার্চ, ১৯৭১ : জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি এলাকায় অসহযোগ আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গুলি চালানোর জন্য ৫৭ নং ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহান সাব আরবাব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ানকে আদেশ দিলে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানরা সে আদেশ অমান্য করে। তখন দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ানকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা সফল হয়নি। মেজর শফিউল্লাহ বাঙালি জওয়ান ও অফিসারদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও বাঙালি ও কর্মচারীদের হাত থেকে দখল করার চেষ্টা করা হয়। ওই ঘটনায় জয়দেবপুর, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এদিন গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা, জয়দেবপুর চৌরাস্তার দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি জওয়ান ও অফিসারবৃন্দ এবং টঙ্গী শিল্প এলাকার শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রেরিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অবরোধ গড়ে তোলে তাকে একাত্তরে বাঙালি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা বলা যেতে পারে। যে সংগ্রামে হরমত, নিয়ামত, মনু খলিফা প্রমুখ শহিদ হন।

বীর জনতা নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা যাতে চালাতে না পারে সেজন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেন। এলাকার জনগণ গাজীপুর অস্ত্র কারখানা প্রহরারত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র যাতে করতে না পারে সে জন্য সেসব এলাকায়ও অসংখ্যা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ফরাসি বিপ্লবের সময়কার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।

এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যারিকেডমুক্ত করার জন্য বিপ্লবী জনসমুদ্রের উপর হালকা মেশিনগান ও রাইফেলের গুলি চালায়। সেনাবাহিনীর লোকজন গ্রামে গ্রামে ঢুকে লোকজনদের এমনকি বাড়ির নারীদের উপরও নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে একজন বীর বাঙালি সেনাবাহিনী থেকে কেড়ে নেয়া একটি রাইফেল থেকে প্রতিপক্ষের উপর গুলি চালায়।
সেনাবাহিনীর প্রেসনোটে তাদের উপর গুলিবর্ষণের খবর তারা স্বীকার করে বলা হয় যে, আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করেছি। তবে নিহত হয়েছে মাত্র একজন।

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের নিকট জয়দেবপুর জনগণের উপর গুলি বর্ষণের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ‘তারা যদি মনে করে থাকে যে, বুলেট ও শক্তিবলে জনগণের সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখা যাবে তাহলে তারা আহম্মকের স্বর্গেই বাস করছে। জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয় তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।’

আজ সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে মুজিব-ইয়াহিয়া দেড় ঘণ্টা বৈঠক হয়। দু’পক্ষের উপদেষ্টাদের প্রথম বৈঠক হয় সন্ধ্যায়। আওয়ামী লীগের পক্ষে এ বৈঠক যোগদান করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দীন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে শরিক হন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেল গিয়াস, প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এসজিএম পীরজাদা এবং সেনাবাহিনীর জজ অ্যাডভোকেট জেনারেল কর্নেল হাসান।

ইয়াহিয়ার সাথে সকালে আলোচনার পর শেখ মুজিব তাঁর বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে কথাবার্তা বলেন। তিনি বলেন, ‘এ ব্যপারে আলোচনা সাধারণ ব্যাপার নয়। এ জন্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন।’
জনৈক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, ‘কবে পর্যন্ত আলোচনার অগ্রগিত সম্পর্কে তারা জানতে পারবেন।’ বঙ্গবন্ধু হেসে বলেন, ‘অপেক্ষা করুন। দয়া করে আমার সুন্দর দেশ এবং ভাগ্যাহত মানুষদের দেখুন।’ ওই সাংবাদিক প্রশ্ন করেন-‘কবে আপনি শেষবারের মত হাসবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ বড় কঠিন প্রশ্ন। আপনি নিজেই আঁচ করুন।’

এদিকে জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টার খবরে রোষদীপ্ত লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শত শত জঙ্গি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সম্মুখে আছড়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এক ক্রুদ্ধ সমাবেশে তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘কত রক্ত তোমরা চাও? কত রক্তে তোমাদের তৃষ্ণা মিটবে?’ তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, তিনি কোনোদিনই শহিদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা আমাদের বংশধরদের জন্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচার ব্যবস্থা করে যাবো।

ভারতের সর্বোদল নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ (প্রয়াত) দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাসী বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক এবং প্রত্যেক সরকারকেই শেখ মুজিব ও নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করা উচিৎ।’ তিনি শেখ মুজিবের অসাধারণ নেতৃত্বের উচ্চসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘গান্ধীজীর পর শেখ মুজিবই অহিংসার দুর্জয় শক্তিকে এত ব্যাপকভাবে প্রদর্শন করেছেন। জনগণকে এমন সাফল্যের সাথে ঐক্যবদ্ধ করার নজির ইতিহাসে বিরল।’
ঢাকায় নিযুক্ত রুশ কনসাল জেনারেল পেট্রেভ ভালটিন বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বাসভবনে দেখা করেন।

রাজশাহী সাংবাদিক সমিতি রাজশাহীর ভুবন মোহন পার্কে রাজশাহীতে অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে পাক-বাহিনীর মিথ্যাচারের প্রতিবাদে এক সভা আয়োজন করে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ সভায় বলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনকালীন রাজশাহীর ঘটনাবলি সংক্রান্ত খবরের সত্যতা অস্বীকার করে প্রদত্ত সামরিক সরকারের প্রেসনোট ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। সভায় এপিপি সংবাদদাতা অধ্যাপক আবদুল আজিজ, রাজশাহী প্রেসক্লাব সভাপতি আর সাঈদ, মর্নিং নিউজের নেহাল আখতার, দি পিপল-এর মোহসীন আলী প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
আজকের ঢাকার কয়েকটি সংবাদপত্রে যুবক-যুবতীদের রাইফেল ট্রেনিং গ্রহণের আলোকচিত্র ছাপা হয়।