খেজুর রস ও গুড় থেকে ১৪৭ কোটি টাকার বাণিজ্য!

আপডেট: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


শীতকাল মানে হাড়কাঁপুনে ঠাণ্ডা। আর মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম। এজন্য এক সময় তীব্র শীতের মাঝেও খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতেন গাছিরা। শীতকাল আসলেই খুব ভোরে এলাকার গাছিরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করতে ছুটে যান। এসময় তারা খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালি গুড় বিক্রি করে লাভবান হন। খেজুর রস দিয়ে শীত মৌসুমে পিঠা ও পায়েস তৈরির প্রচলন দীর্ঘদিনের।

শীত এলেই বরেন্দ্র ভূমির ঘরে ঘরে পিঠাপুলি ও পায়েস তৈরির ধুম পড়ে। আর যে রস বা গুড় ছাড়া পিঠা- পায়েসের স্বাদে পূর্ণতা আসে না সেটি হলো খেজুর রস ও গুড়। আর গাছ থেকে সেই রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা।

তবে এবার কাঁচা খেজুরের রস খাওয়াতে নিষেধ করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেজুরের রস সংগ্রহ করে তা ফুটিয়ে পান করতে। নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশের বেশি। নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া যাবে না। গতবছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ রামেক হাসপাতালে সন্দেহভাজন ৬৪ জন এসেছিল। তারমধ্যে আক্রান্ত পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে রাজশাহী, পাবনা, নটোরের একজন করে। এছাড়া নওগাঁ দুইজন মারা গেছেন। এই রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, রাজশাহীতে ৫৪৪.৭ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ রয়েছে প্রায় ১১ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩টি। চলতি মৌসুমে যে গাছগুলো থেকে ৮ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন খেজুর গুড় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এছাড়া এবার রস ও গুড় থেকে বাণিজ্যের প্রত্যাশা ১৪৬ কোটি ৭৮ লাখ ৭ হাজার ৬০ টাকা।
রাজশাহীর ৯টি উপজেলার গ্রামগুলোতে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। তবে চারঘাট, বাঘা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর ও পবা উপজেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রতি বছর শীত মৌসুমে খেজুর গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। গাছ তৈরি, রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি, বাজারজাত ও পরিবহণসহ সব মিলিয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

চারঘাট উপজেলার সারদা এলাকার চাষি মোহাম্মদ করিম বলেন, আমার জমির আইল এবং পুকুরপাড়ে দেড়শ খেজুর গাছ আছে। ইতোমধ্যে ৫০টি গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বাকি গাছগুলোও প্রস্তুতের প্রক্রিয়া চলছে। আর কয়েক দিনের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি গাছ থেকে স্বল্প পরিমাণে রস সংগ্রহ শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত শীত মৌসুমে দেড়শ গাছের রস থেকে গুড় তৈরি করে প্রায় চার লাখ টাকা আয় হয়েছে। এছাড়া ৩০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

দুর্গাপুর উপজেলার কানপাড়া এলাকায় গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত গাছি শফিকুল ইসলাম বলেন, অক্টোবরের শেষ থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি প্রায় সাড়ে চার মাস আমরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। একেকজন গাছি প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, গাছ পরিচর্যা এবং রস সংগ্রহের জন্য গাছের মালিক আমাদের প্রতিদিন তিনশ টাকা পারিশ্রমিক দেন। মাত্র কয়েক ঘন্টা কাজ করে আমরা এ টাকা উপার্জন করি।

পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর এলাকার দিলরুবা খাতুন খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করেন। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ পর থেকে গুড় তৈরি শুরু হবে। এজন্য পারিশ্রমিক হিসাবে পাঁচশ টাকা দেন মালিক। এর মাধ্যমে আমার মতো অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, শীত মৌসুমে সাড়ে চার মাসে একটি গাছ থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কেজি গুড় উৎপাদন হয়। খেজুরের গুড়কে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি রাজশাহীতে একটি কর্মশালায় খেজুরের রস খাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, নিপাহ একটি ভাইরাসজনিত মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগ। সাধারণত শীতকালে নিপাহ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। খেজুরের কাঁচা রসে বাদুরের বিষ্ঠা বা লালা মিশ্রিত হয় এবং ওই বিষ্ঠা বা লালাতে নিপাহ ভাইরাসের জীবাণু থাকে। ফলে খেজুরের কাঁচা রস পান করলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোরেরা নিপাহ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। খেজুরের কাঁচা রস সংগ্রহ, বিক্রয় ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাছিদের এবং জনসাধারণদের প্রাণীবাহিত সংক্রামক ব্যাধি রোগ নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে অবহিত করা হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ