ঈশ্বরদী শহরের মাদ্রাজিপট্টির তেলেগুভাষী তামিলরা এখনো ধরে রেখেছেন তাদের ভাষা

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪, ৯:৫৪ অপরাহ্ণ


সেলিম সরদার, ঈশ্বরদী:ঈশ্বরদী পৌর শহরে আটকে পড়া প্রায় ১৮ হাজার পাকিস্তানি রয়েছেন যারা উর্দু ভাষায় কথা বলেন। শহরের ফতেমোহাম্মদপুর ও লোকো কলোনী এলাকায় এদের বসবাস। এই ঘনবসতি বিহারী অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে তেলেগুভাষী তামিল সম্প্রদায়ের অর্ধশতাধিক আদিবাসী রয়েছেন যারা জুনজুরা বংশের অনুসারি তেলেগুভাষী তামিল সম্প্রদায়। চার পাশে হাজার হাজার বিহারীদের মধ্যে এই অর্ধশত তেলেগুভাষী তামিলদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষার জন্য এক সময় এখানে একটি পাঠশালাও ছিল। তাদের ভাষা চর্চার জন্য নিজস্ব ভাষার বই ছিল। ছিল শিক্ষকও। তাদের ধর্মীয় আচার ও পূজা অর্চনার জন্য একটি মন্দির ছিল যা ৬৭ বছর পর সম্প্রতি উদ্ধার হয়েছে। নিউকলোনী মাদ্রাজী পট্টিতে ‘শ্রীরামনী সেবা সংগম’ নামক প্রাচীন এই মন্দিরে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রী রামচন্দ্র ও সীতাদেবীর যুগল প্রতিমা স্থাপন করার পর পূজা অর্চনা, বন্দনা ও ধর্মীয় আয়োজনে পূজা উদযাপনও শুরু করেছেন তারা।

ঈশ্বরদী কালের আবর্তে এখন তামিলদের সংখ্যা কমতে কমতে যেমন ১৩-১৪টি পরিবারে এদের সংখ্যা এসে ঠেকেছে গুনে গুনে ৫৫ জনে। তেমনি নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রও এখন আর নেই। তবে তারা বিহারী ও বাঙালিদের সঙ্গে বসবাসের কারনে কর্মক্ষেত্রে উর্দু ও বাংলায় কথা বললেও পরিবারে বসবাসের সময় এবং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার সময় সবাই এখনো কথা বলেন তেলেগু ভাষায়। পরিবারের শিশুরাও বাইরে উর্দু ও বাংলায় কথা বললেও বাড়িতে পরিবার পরিজন ও আত্মিয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন তেলেগু ভাষায়।

বুধবার ঈশ্বরদী শহরের ফতেমোহাম্মদপুর মাদ্রাজীপট্টি আদিবাসী পাড়ায় সরেজমিন তামিল সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জুনজুরা বংশের অনুসারি তেলেগুভাষী তামিল সম্প্রদায়ের প্রবীণ আদিবাসীরা জানান, ঈশ্বরদীর ফতেমোহাম্মদপুর নিউকলোনী এলাকায় ১৯৫৫ সালে ‘শ্রীরামনী সেবা সংগম’ নামের একটি মন্দির স্থাপন করা হয়। সে সময় ওই মন্দিরের বারান্দায় তামিল ভাষায় একটি পাঠশালা পরিচালনা করা হতো। মন্দিরে মাঝে মধ্যে অস্থায়ী ভাবে প্রতিমার ছবি বা প্রতিকৃতি বসিয়ে তখন পূজা অর্চনা করতেন এসব আদিবাসীরা। ২০১৪ সালে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠান পালনের সময় স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই রাম মন্দিরের কার্যক্রম শুরু করলেও তা একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।

ঈশ্বরদী মন্দির ও তেলগু ভাষার সেই পাঠশালার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের শিক্ষক (সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক) ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদ পাবনা জেলা কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শ্রী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, প্রাচীন এই মন্দির স্থাপনের তৎকালীন সময়ে আমি মন্দিরের বারান্দায় তেলেগুভাষী তামিল সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের তাদের ভাষায় পড়াতাম। তামিল সম্প্রদায়ের অনেকে বিহারীদের মাঝে বসবাস করতে না পেরে ভারতে চলে যাওয়ায় এই এলাকায় তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। এক পর্যায়ে তেলেগু ভাষার শিক্ষাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রায় ৬৭ বছর পর ওই মন্দিরটি আবার চালু হয়েছে। এখানে শ্রী রামচন্দ্র ও সীতাদেবীর যুগল প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। ধর্মীয় আচার হলেও তাদের ভাষা শিক্ষার কোন ব্যবস্থা এখন আর নেই।

মাদ্রাজীপট্টির প্রবীণ আদিবাসী শ্রীমতি চম্পা রাণী (৭০) ও শ্রীমতি দেওড়াম্মা জানান, ছোটবেলায় এই মন্দিরের বারান্দায় আমরা আমাদের ভাষায় (তামিল) পড়ালেখা করতাম। সেখানে আমাদের তামিল ভাষা শেখানো হতো। এখনো আমরা আমাদের ভাষাতেই কথা বলি। তবে বিহারী ও বাঙালিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে আমরা এখন উর্দু ও বাংলাতেই কথা বলি।

ঈশ্বরদী মন্দিরের সভাপতি রামু নাইডু বলেন, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে সম্প্রতি আমরা আমাদের ধর্মীয় উৎসব আমাদের মন্দিরে উদযাপন করতে শুরু করেছি তবে নিজেদের ভাষা শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক চিন্নারাও বলেন, এই মাদ্রাজীপট্টি বা আদিবাসী পাড়ায় তেলেগুভাষী ৫০ থেকে ৫৫ জন তামিলরা বসবাস করেন। মন্দিরের সিনিয়র সহসভাপতি শ্রী শংকর সাহা বলেন, নিজেদের উদ্যোগে নিজেরাই এই মন্দিরে রাম সীতার প্রতিমা স্থাপন করে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার পালন করছি। আমরা সবাই খুবই গরিব, আমরা সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। যাতে আমাদের কৃষ্টি-সং¯কৃতির মধ্যেই আমরা বেঁচে থাকতে পারি।

ঈশ্বরদী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্রী সুনিল চক্রবর্তী বলেন, আমরা এই অর্ধশতাধিক তামিল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব আয়োজনে তাদের সাথে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। তবে তাদের ভাষা শিক্ষার কোন ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি।

ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র ইছাহক আলী মালিথা বলেন, ঈশ^রদী পৌর এলাকার লোকো কলোনীতে তেলেগুভাষী তামিল সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো বিহারী বাঙালিদের সঙ্গে মিলে মিশে বসবাস করেন। তাদের ধর্ম, কর্ম, বসবাস নিয়ে কোন সমস্যা নেই আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকেও তাদের খোঁজ খবর রাখি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ