পিছিয়ে পড়া নারীদের নেতৃত্ব বিকাশে নওগাঁর ‘তুর্কি আপা’

আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪, ৪:৫৩ অপরাহ্ণ

আব্দুর রউফ রিপন, নওগাঁ:


নারীরাও যে শত বাধা আর বিপত্তি উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণের নাম হচ্ছে মোছা. আফেলাতুন নেছা। ১৯৫৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে নওগাঁ জেলার অর্ন্তগত সদর উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের মৃত-বয়তুল আলী প্রামাণিক ও মাতা খাতেজান বেওয়ার একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। ছোট বেলা থেকেই অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী আফেলাতুন নেছা নদী সাঁতরে ১৯৬৪সালে সদর উপজেলার চকউজির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি প্রাপ্ত হন এবং অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে তিনি ১৯৭০সালে এসএসসি পাশ করেন।

পরবর্তিতে পারিবারিকভাবে সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের দোগাছী গ্রামের বাংলাদেশ রেলকর্মচারী তুমিজ উদ্দিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর সংসারের কাজের ভারে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে বোয়ালিয়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত সদস্য হিসেবে ৫মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। মানুষের নায্য অধিকার আদায়ে বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারীদের নেতৃত্ব বিকাশে এবং স্পষ্টভাষী অদম্য সাহসের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক উত্তরবঙ্গের কৃতি সন্তান মরহুম আব্দুল জলিল আফেলাতুন নেছাকে ‘তুর্কি’ উপাধি দেন। সেই থেকে তিনি এলাকায় ‘তুর্কি আপা’ নামে অধিক পরিচিত।

২০১১ সাল থেকে তিনি অপরাজিতা প্রকল্পে যুক্ত হন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, আইনগত সহায়তা প্রাপ্তিতে সহায়তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিক, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট নির্মাণ, নারীদের জন্য আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে এলাকার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। ২০১৯সাল থেকে অপরাজিতা প্রকল্পের উৎসাহে নিজেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করার লক্ষ্যে নিজেকে গোছাতে থাকেন এবং ২০২১ সালে ১১নভেম্বর নৌকা প্রতিক পেয়ে সদর উপজেলার ৭নং বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে একজন অপরাজিতা হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অপরাজিতা প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অপরাজিতা প্রকল্প উৎসাহ, সাহস, তথ্য সহায়তা, নমিনেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং প্রচার-প্রচারনায় ব্যাপক সহায়তা করেছে। তাই অপরাজিতা প্রকল্পের দেখানো স্বপ্নেই ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পেরেছেন বলে জানান তুর্কি।

আফেলাতুন নেছা অপরাজিতা প্রকল্পের সংস্পর্শে এসে প্রশিক্ষণে পাওয়া জ্ঞান-দক্ষতাকে পুঁজি করে পিছিয়ে পড়া নারীদের ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অদম্য শক্তি অর্জন করেছেন। তিনি নওগাঁর মধ্যদিয়ে বয়ে চলা ‘তুলশিগঙ্গা’ নদী খনন ও খননকৃত মাটি প্রভাবশালী মহলের আত্মসাৎ প্রতিহত করতে শাসকদলের নেতাকর্মীদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে নানা রকম হয়রানী মোকাবিলা করেছেন। তুলশীগঙ্গা পাড়ের মানুষের কান্নার সাথে একত্ত্বা ঘোষনা করে স্রোতের বিপরীতে যুদ্ধ করছেন।

তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসনের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন। তার এমন কর্মকান্ডে খুশি হতে না পেরে ইউনিয়ন পরিষদের সকল সদস্যরা তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ প্রদান করে। অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা না পেয়ে বরং অভিযোগকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ বেরিয়ে আসে। এরপর থেকে তুর্কিকে নানা ভাবে অসহযোগিতা মূলক হয়রানী অব্যাহত রাখে সদস্যরা। এতকিছুর পরও অন্যায় আর মিথ্যের কাছে তুর্কি মাথা নত না করে প্রতিনিয়তই এগিয়ে চলেছেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে অপরাজিতা আফেলাতুন নেছা জানান, তিনি সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত মানুষদের অধিকার আদায়ে কখনো পিছপা হবেন না। কখনোও অন্যায়, মিথ্যে ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে আপোষ করবেন না। ভোর-সকাল থেকে সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত পায়ে হেটে বিভিন্ন অফিস ও মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে চলেছেন সকলের প্রিয় ‘তুকি আপা’।

নিজে থেকেই খোঁজ নিচ্ছেন এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের। তিনি স্বপ্ন দেখেন সমতার সমাজ শিগগিরই প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে নারী-পুরুষ সমান আত্ম-বিকাশের সুযোগ পাবে। চলমান পুরুষ তান্ত্রিকতার পরিবর্তে গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক নতুন সমাজ ব্যবস্থা। আগামীতে সুযোগ পেলে সংসদ সদস্য হয়ে সমাজ ও দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিতে আরো কাজ করার আগ্রহের কথা তিনি জানান।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ