বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ


তামিম শিরাজী:পড়ালেখা শিখলেই যে শিক্ষিত হওয়া যায় না এ সত্যটি আমাদের সমাজে খুব একটা জনপ্রিয় নয়। এখানে শিক্ষিত বলতে পড়ালেখা জানাকেই বোঝায়। সার্টিফিকেটের স্কেলে আমরা মাপতে শিখেছি জ্ঞানের পরিমাণ। সে বিবেচনায় আমরা কমবেশি সকলেই শিক্ষিত হলেও, প্রকৃত বিচারে কতখানি শিক্ষিত হলাম সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা সম্প্রতি কিছু ঘটনা এ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষিত জাতি তৈরির কারিগর হলেন শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শাসন করতে হাতে ছড়ি নিতে আমরা শিক্ষকদের দেখেছি, তাই বলে পিস্তল ! এতো কল্পনারও অতীত। অথচ দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলেও ঘটনাটি ঘটেছে। সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রকে গুলি করবার ঘটনা আমরা সবাই হতবিহ্বল হয়ে দেখলাম। কতিপয় বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা শিক্ষকের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে ঘটানো নানান ঘটনা অধঃপতনের নিশ্চিত সূচক নির্দেশ করলেও, এবারের ঘটনা পূর্ববর্তী সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।

সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে কিছু চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসছে, সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, শিক্ষক রায়হান শরীফ হরহামেশাই শিক্ষার্থীদের সামনে অস্ত্রের প্রদর্শন করে থাকতেন। এমনকি গুলি ছুড়বার ঘটনাও ঘটিয়েছেন একাধিকবার। শ্রেণিকক্ষে তার প্রদর্শিত অস্ত্রের তালিকায় পিস্তল ছাড়াও স্থান পেতো বিভিন্ন ধরনের চাকু, তলোয়ার এবং অন্যান্য মারণাস্ত্র। তথাকথিত অবাধ্য শিক্ষার্থীদের শাসন করতে এসব ব্যবহার করতেন তিনি। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা যে ক্লাস তিনি নিচ্ছিলেন সেটি তার নিজের রুটিন ক্লাসও নয়, অন্য এক শিক্ষকের ক্লাস এবং ভীতি প্রদর্শন পূর্বক অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্লাস নিতেন। কলেজ নিয়মের তোয়াক্কা না করে এমন অনেক ঘটনায় ঘটিয়ে আসছিলেন রায়হান শরীফ। যখন খুশি তখন ক্লাস নেওয়া, শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয়ভীতি সৃষ্টি, নেশায় উৎসাহ প্রদান এবং নারী শিক্ষার্থীদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার মতো নানান সাঙ্ঘাতিক অপরাধের বিবরণ উঠে এসছে ভুক্তভোগিদের ভাষ্যে।

ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা থাকার সুবাদে অস্ত্রের সাথে তার পরিচয় এবং পরিণয় গড়ে উঠে। ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অস্ত্রের ব্যবহার ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষক জীবনেও ধরে রেখেছিলেন তিনি। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা কলেজ প্রশাসনের সতর্কতা এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, কিংবা বলা যায় পর্যাপ্ত প্রচেষ্টার অভাব ছিল। কারণ ঘটনাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে আসছিল ইচ্ছা করলেই এসবের বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নেওয়া যেতো সেক্ষেত্রে অবস্থার এতোটা অবনতি ঘটতো না। কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তবে এই ঘটনায় কিছু বিষয় আমাদের সামনে উঠে এসছে যা কমবেশি সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষক সন্ত্রাস চলছে তা রীতিমত ভয়াবহ।

শিক্ষকদের ভয়ে তটস্থ শিক্ষার্থীদের সবসময়ই চোখ রাঙানি, ধমকানি সহ্য করতে হয়। শিক্ষকরা নিজের ইচ্ছামতো আসেন, যখনতখন ক্লাস নেন, যা ইচ্ছা শেখান, যেভাবে ইচ্ছা পরীক্ষণ করেন। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মতো মারাত্মক অভিযোগ হরহামেশাই উঠে আসছে। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণ্ডি পেরিয়ে আজকাল কলেজ এমনকি স্কুল পর্যায়েও শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে। ইদানিং বাচ্চাদের অভিভাবকের কাছে ম্যাসেজ চলে আসে একেক দিন একেক সময়ে ক্লাস পরীক্ষা স্কুল শুরুর সময় জানিয়ে। যেন কোনো নির্দিষ্ট রুটিন কিংবা শৃঙ্খলা নেই যে যার ইচ্ছা মতো শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সৃজনশীল শিক্ষার অবারিত পরিবেশ সৃষ্টিতে এমন পরিবেশ হয়ত আশির্বাদ হতে পারতো তবে আমাদের সমাজে তা অভিশাপ হয়েই দেখা দিচ্ছে। শিক্ষকের ক্ষমতার অপব্যবহার আর স্বেচ্ছাচারিতা সর্বময় দৃশ্যমান হচ্ছে। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের উচিৎ শিক্ষকদের ব্যক্তি ক্ষমতা কমিয়ে এনে তাদের নির্দিষ্ট রুটিনের আওতায় আনা। শিক্ষকদের ক্ষমতা যেন শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সে ব্যাপারেও প্রতিষ্ঠান প্রশাসনকে কার্যকরি ভূমিকা নিতে হবে। সততা, পেশার প্রতি নিষ্ঠা এবং মানবিক মূল্যবোধ থাকলে গুটিকয়েক উল্লিখিত শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রিত করা প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের জন্য খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না।

শিক্ষিতের এলিট ক্লাস হিসেবে পরিচিত সড়ংঃ ষবধৎহবফ ঢ়বড়ঢ়ষব আইনজীবীদের নির্বাচনকে ঘিরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে মহোৎসব হয়ে গেল, তা একই সাথে নিন্দনীয় এবং উদ্বেগেরও বটে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এমন ন্যকারজনক ঘটনা এর আগে বোধহয় দেখা যায়নি। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা এইতো ক’দিন আগে রাজশাহীতে আইনজীবীদের নির্বাচনে হাতাহাতি, ব্যালট বাক্স ভাঙচুর, ফলাফল ঘোষণায় অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও ঢাকাতে বহিরাগত সন্ত্রাসী দ্বারা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আক্রান্ত হবার ঘটনা অবক্ষয়ের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সারাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনা, প্রতিপক্ষের উপর হামলা এমনকি হত্যাকাণ্ড আমাদের কাছে সহনীয় হলেও, আইনজীবীদের নির্বাচনে এসবের ভিন্নতা ছিল।

দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী আইনজীবীদের নির্বাচনগুলো বিগত দিনে হতে দেখেছি গণতান্ত্রিক, শিষ্টাচার এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ। গেল বছরগুলোতে আইনজীবীদের নির্বাচন সবকটি আবেদন হারিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের নোংরা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

শিক্ষক এবং আইনজীবীরা শিক্ষার স্তরের সবচেয়ে উপরের কাতারের মানুষ হয়েও তাদের এমন অশিক্ষিত সুলভ আচরণ আমাদের হতাশ এবং আতঙ্কিত করেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেবল কিছু পড়ালেখা জানা লোক তৈরি করছে, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে একথা বললে খুব একটা ভুল হবে না। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক কালচার সর্বময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

প্রতিহিংসা, অবৈধ পন্থা অবলম্বন, অসহিষ্ণুতা, কূট চক্রান্ত, মূল্যবোধের অভাব বর্তমানে জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। এ দায়ভার অবশ্যই রাজনৈতিক নেতাদের নিতে হবে, সেইসাথে বুদ্ধিজীবী সামাজিক সাংস্কৃতিক বিজ্ঞজনেরাও সমান দায়ি। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা রাজনৈতিক নেতারা তাদের আরো আরো ক্ষমতাবান করতে আর বুদ্ধিজীবীরা সেই ক্ষমতার আগুনের আঁচে নিজেদের উষ্ণ করতে গিয়ে দেশে যে অপসংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন তা অশিক্ষার এক প্রকাণ্ড ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যে রূপ নিয়েছে।

অথচ অত্যন্ত নৈতিক এবং আদর্শিক লড়াইয়ের মধ্য দিতে গড়ে ওঠা এই জাতির তো এমন হবার কথা ছিল না। যখন থেকে আমরা আমাদের মূল জায়গা থেকে সরে গেছি তখন থেকেই এই অধঃপতনের সূত্রপাত। বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে, সকলের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। বিজ্ঞজনের অজ্ঞতা বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা বাস্তবায়িত হলে হয়তো আজ চিত্র ভিন্ন হতো। ক্রমশ নিমজ্জমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চার মূলনীতির চর্চা এবং প্রয়োগ আমাদের সহায়ক হবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, রাজশাহী মহানগর।