আজ অমর একুশে- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

সর্বস্তরে বাংলার অপেক্ষা আর কতদিন!

আজ অমর একুশে। মহান ‘শহিদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। দিবসটি বিশ্বের সব জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষায় ঐক্য ও বিজয়ের শপথ-শক্তির জাগরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহিদ দিবস। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিস্তারিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে এ দিবসটি।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরব প্রকাশের দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ আরও অনেকে।

আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তস্নাত গৌরবের সুর বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের প্রাণে অনুরণিত হচ্ছে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আনন্দের কথা- ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সিটি কাউন্সিলে ‘রেজ্যুলেশন ৪৭৪’ পাশের মধ্যদিয়ে দিবসটিকে ঘটা করে পালনের পথ সুগম করা হয়।

আজ সারা বিশ্বের সব নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস মহান একুশেÑআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইউনেস্কো বাংলাকে পৃখিবীর সবচেয়ে মিষ্টভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব কিছুই বাঙালি জাতির গৌরবের উত্তরাধিকার। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দাবি উত্থাপন সহ বিশ্বের সকল ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং ভাষা সংরক্ষণের জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু আমরা মনে করি, এই ইন্সটিটিউটের পরিধি বাড়ানো দরকার। অন্তত বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাষা ইন্সটিটিউিট প্রতিষ্ঠাও কাক্সিক্ষত। আঞ্চলিক ভাষা এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বিভাগীয়
পর্যায়ের ভাষা ইন্সটিটিউিটগুলো। আর গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের দাবি তো আছেই। দাবি আছে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার।

সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- দেশে অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আগ্রহ বিশ্ব সাহিত্যের প্রতিই আগ্রহ। এ আগ্রহ এই প্রয়োজনও সামনে এনেছে যে, দেশে একটি শক্তিশালী অনুবাদ সেল গঠন করার প্রয়োজন। যা স্বাধীনতার ৫২ বছরেও হয়নি। এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা স্পষ্ট। সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের কথা আমরা বলছি, সরকারি নির্দেশনাও আছে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্র তৈরিতে যে উদ্যোগের প্রয়োজন তা নেই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার দাবিটিও উপেক্ষিত। এ ক্ষেত্রে দক্ষ অনুবাদক তৈরির আবশ্যকতা আছে। আমরা বিজ্ঞানমনষ্কতার কথা বলছি অথচ বিজ্ঞানকে সহজ অনুবাদ করে বাংলায় চর্চার কথা বলছি না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সক্ষম বাংলা ভাষাকে অক্ষম করে রাখা এটা বাংলা ভাষার সমস্যা নয়Ñসমস্যা মানসিকতার।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলায় আদেশ-রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত। শুনানির শুরুতে হাইেকোর্ট বলেন, ‘আজ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন। আজ আমরা বাংলায় দেবো সব আদেশ।’ এরপর একের পর এক আদেশ ও রায় বাংলায় দেন হাইকোর্টের এই বেঞ্চ। তবে বাংলায় রায় প্রদানের বিষয়টি যাতে প্রতিকী না হয়। বাংলায় রায় দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। রায় প্রদানে ইংরেজির আবশ্যকতা থাকলে সেটা যাতে বাংলা থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়। যেমনটি আমাদের সংবিধানের ক্ষেত্রে হয়েছিল।

প্রচলিত আইনগুলো বাংলায় ভাষান্তরিত করার দাবি দীর্ঘদিনের। সময়ে সময়ে এই দাবি সামনে এলেও এর বাস্তবায়ন দেখা গেছে খুবই কম। ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিচার প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলে ধরার জন্য আইন বাংলা করার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব দাকি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। সর্বস্তরে বাংলা চালুর ঘোষণা এবং অমর একুশের আকাক্সক্ষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের অঙ্গীকারও বটে।

একুশের চেতনা ধারণ করে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হবে, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো আপন মহিমায় নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে উজ্জীবিত হবে এবং গড়ে উঠবে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য বিশ্ব।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দায় পূরণে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগি হতে হবে। ভাষার উৎকর্ষতা সাধনে গবেষণা উদ্যোগও তেমন এগোচ্ছে না। গবেষণায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ এবং নির্দিষ্ট খাত নির্ধারণ করাও সময়ের দাবি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের হার না মানা চেতনাকে সঙ্গী করে দেশ গঠনে ব্রতী হলে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হবে। টেকসই উন্নয়ন ধারণার বীজ এখানেই উপ্ত আছে। একটি সুখি-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এ অপরাজেয় চেতনা হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে সেটা সম্ভব হবে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে।