জাতীয় গণহত্যা দিবস

আপডেট: মার্চ ২৫, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরে বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল পাকিস্তান
আজ জাতীয় গণহত্যা দিবস। বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ৫৩তম বার্ষিকী আজ। সপ্তমবারের মত দিবসটি বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই ভয়াল ২৫ মার্চকে ‘কালরাত্রি’ হিসেবেই জাতি পালন করে আসছিল। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে দিনটি ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে সারা দেশে পালিত হচ্ছে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এ দেশের নিরীহ- নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলে পড়ে নির্বিচার গণহত্যার সূচনা করেছিল।

পরবর্তী ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি শৌর্য-বীর্য আর বীরত্বের ইতিহাস রচনা করে। বাঙালিরা কাতারে কাতোরে মরেছে কিন্তু পদানত হয়নি- পশ্চাদপদতাকে, কুপমণ্ডকতা-সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নেয়নি। প্রিয় এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছে, চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করে সারা দেশকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করে, লুটপাট করে, দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর আর কোনো জাতিকে এতো মূল্য দিতে হয়নিÑ যা বাঙালিদেরকে দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা বিশ্ব ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে খুবই পরিকল্পিত উপায়ে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ঘুমন্ত বাঙলিদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরের সূচনায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। ইতিহাসের দায় থেকেই ২৫ মার্চ কালরাত্রির দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এরজন্য আওয়ামী লীগ সরকার ধন্যবাদ- প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মদান, চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বরে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।

১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সার্বজনীন মানবাধিকার বিষয়ে যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ‘মানব ইতিহাসে যেসব গণহত্যা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা অন্যতম। ১৯৭১ সালে সবচেয়ে কমসময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার হতে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ দৈনিক গড়।’

সাবেক মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালে ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের ত্রাণ শিবির পরিদর্শন শেষে খুবই মর্মাহত হন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর গণহত্যাকে তিনি ‘সারা বিশ্বের জন্য ট্রাজেডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা শুধুমাত্র পাকিস্তানের জন্য পূর্ববাংলার ট্রাজেডি নয়, এটা ভারতের জন্যও শুধুমাত্র একটি ট্রাজেডি নয়, এটা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি ট্রাজেডি এবং এই সঙ্কট নিরসনের জন্য একসাথে কাজ করাটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব ছিল।’

১৯৭২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পরে এই তথ্যটি প্রকাশিত হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এই তথ্যটি নিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করা যেতে পারে।

২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের যৌক্তিকতা খোদ পাকিস্তানই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধে একটি মীমাংসিত বিষয় ৩০ লক্ষ শহিদ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা একাত্তরে বাঙালিদের ওপর যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তা শুধু অস্বীকারই করছে না, বিশ্ববাসীকেও বিভ্রান্ত করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টাও চালিয়ে আসছে। আর এসব করছে তারা যুদ্ধাপরাধের দায় এড়াতে। শুধু পাকিস্তানিরাই নয়Ñ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও এ ষড়যন্ত্র বিদ্যমান আছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

খোদ দলটির চেয়ারপার্সন ৩০ লক্ষ শহিদের মিমাংসিত বিষয়টিকে বিতর্কিত করতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বাংলাদেশের এ ব্যাপারে নিরব থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রামাণিক দলিলসহ একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের বিষয়টি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে হবে। দিবসটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য বিশ্ব স্বীকৃতি লাভের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
একাত্তরের শহিদদের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।