অপেক্ষায় সারাবেলা

আপডেট: নভেম্বর ১৭, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সিরাজুল ইসলাম মুন্টু
১.
মমতার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হলো। এখন সে গৃহিনী, শুধু গৃহিনী বললে ভুল হবে একবারে সু-গৃহিনী। তার স্বামী পঁচিশ বছরের টকবগে যুবক। নাম মনির মিয়া। আর দশ বছরের দেবর মুনু মিয়া। এই তো তার পৃথিবী। এই তিন জনের সংসার। মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ের জন্য একটা সংসারে যা যা থাকার দরকার তার সব কিছু আছে মমতার। গোয়ালে গরু আছে পুকুরে মাছ আছে গোলায় ধান আছে আর ক্ষেতে আছে নানান রকমের সবজি। একটা গৃহস্থ পরিবারের জন্য এর চেয়ে আর বেশি কিছুর কি-ই বা দরকার।
মনির মিয়া যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন তার বাবা হাসমত মিয়া মারা যায়। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে মনির মিয়ার আর লেখাপড়া হয়নি। মা ছেলে মিলে সংসারের কাঠামোটাকে ঠিক রেখেছে। অসম্ভব কাজের ছেলে এই মনির মিয়া। সকাল থেকে সাঁঝ পর্যন্ত সে মাঠে কাজ করে। মাঠের কাজে তার একটুও অনিহা নেই। লোকে মনির মিয়াকে বলে কাজ পাগল ছেলে। মনির জানে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। কাজ ছাড়া জীবনে উন্নতি করা যায় না। মমতা মনির মিয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। মনিরও মমতাকে ভালোবাসে। ওদের সংসারে সুখ থাকলেও কোথায় যেন একটু অশান্তির ছোঁয়া লেগে আছে। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে মমতার কোল জুড়ে একটা ফুটফুটে ছেলে কিংবা মেয়ে এলোনা। দুজনের মনের ভেতর একটা অব্যক্ত কষ্ট
আছে। মনির মিয়া মাঝে মাঝে মমতাকে সান্ত¦না দেয়। দেখ মমতা ছেলে মেয়ে সেটা তো আল্লাহর হাতে তাছাড়া মুনু মিয়া সেতো আমাদের ছেলের মত। যদি ছেলে মেয়ে আল্লাহ না দেয় তো ক্ষতি কি। মুনু মিয়াকে আমরা ছেলের মত মানুষ করিব। মুনু মিয়া আমাদের ছেলে মেয়ের অভাব পূরণ করবে। মুনু মিয়াও মমতাকে খুব ভালোবাসে। মুনু মিয়া যেন ভাবীর নেওটে। মমতাকে ছাড়া সে আর কিছুই বুঝেনা। মমতা একটু চোখের আড়াল হলেই সারা বাড়ি মাথায় করে তুলে।
মমতা মনির আর মুনু মিয়ার সুখ বেশিদিন স্থয়ী হলোনা। একদিন হাটবারে চকগৌরী হাট হতে অনেক রাতে ফিরল মনির মিয়া। এদিকে মমতা ঘর বাহির করে করে ক্লান্ত। নানা ভাবনায় মমতার মন ভরে গেল। মনির রাত করে বাড়ি ফিরেনা। আজ এত রাত অবধি কি করছে? মনিরের কোন বিপদ হয়নি তো। এমন অসংখ্য ভাবনা মমতার মনে উদয় হতে লাগলো। অবশেষে অনেক রাতে মনির দরজায় এসে ডাকলো মমতা দরজা খোল। মমতা দরজার ওপাশেই ছিল তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। মনির বলল, কি ব্যাপার মমতা তুমি কি দরজার এই পাশেই ছিলে? মমতা বলল সেই সন্ধ্যা হতে ঘর বাহির করছি। তুমিতো এত রাত অবধি বাইরে থাকোনা। কল পাড় হতে হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি তোমার খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
খেতে খেতে মনির মিয়া হাটে তার রাত হবার কারণ খুলে বলল, এদেশে পাকিস্তানীরা তাদের সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ ছাড়া ওরা আমাদেরকে স্বাধীনতা দিবেনা। আমরা স্বাধীন হতে পারব না। তাইতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি যুদ্ধে যাব।
আমাদের আশে পাশের গ্রামের অনেকেই যুদ্ধে যাবে। মমতা বলল তুমি যুদ্ধে যাবে আমাদেরকে দেখবে? তাছাড়া তুমি কি নিয়ে যুদ্ধ করবে। মনির বলল, বউ আমরা প্রথমে ভারতে যাব। সেখানে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর যুদ্ধ করব। আর তোমাদের দেখার কথা বলছ, আল্লাহ তোমাদের
কে দেখবে। দেশের এমন দু’র্দিনে নিজের স্বার্থের জন্য বাড়িতে বসে থাকতে পারবনা বউ।
তুমি আমাকে বাধা দিয়োনা। মমতার মনে অনেক কথার জোয়ার এলেও মমতা মনির মিয়াকে আর কিছু বলেনা। মনে মনে সান্তনা খুঁজে মুনু মিয়াতো আছে । মমতা তো একা একা থাকছেনা। এক রাতে মনির মিয়া সহ আশে পাশের গ্রামরে জন বিশেক ছেলে লাপাত্তা। ওরা কোথায় গেছে সে কথা কাউকে বলে যায়নি। ওদের নেতৃত্ব দিয়েছে ফজল মিয়া। বাড়িতে বলেছে ওরা যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। ২৫শে মার্চ কাল রাত হতে শুরু হয় পাকিস্তানী বাহিনীর বাঙালি নিধনের নৃশংস ইতিহাস। হাটে, মাঠে, ঘাটে, পথে-প্রান্তরে পড়েছিলো লাশের স্তুপ। মানুষের রক্তে হোলি খেলায় মেতেছিল তৎকালিন কুচক্রি পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি। আর তার সাথে হাত মিলিয়েছিল বেঈমান বিশ্বাস ঘাতক এদেশীয় কিছু অমানুষ।


যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। ফজলের নেতৃত্বে যারা যুদ্ধে গিয়েছিল তাদের অনেকেই ঘরে ফিরে এসেছে। মমতা ফজলকে জিজ্ঞাসা করেছিল মনির কবে ফিরে আসবে। ফজল বলেছিল আসবে ওর যুদ্ধ শেষ হয়নি। মমতার মনে খটকা লাগে। মমতা নিজেকে সান্ত¦না দিতে পারেনা। বারবার ফজলকে জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর মমতা পায়না। মনির সম্পর্কে কোন কিছুই বলেনা ফজল মিয়া। কয়েকদিন পরে, মমতা সকালে মুনু মিয়ার ঘরে গিয়ে দেখে মুনু মিয়া নাই। বিছানায় একটা কাগজ পড়ে আছে তাতে লিখা আছে “ভাবী তুমি আমাকে খুঁজনা, ভুল বুঝনা, আমি মনির ভাইকে খুঁজতে যাচ্ছি। মনির ভাইকে খুঁজে নিয়ে দুই ভাই একসাথে বাড়ি ফিরে আসব।”
স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তীও পালন হয়ে গেছে। আজও ফিরে আসেনি মনির মিয়া আর মুনু মিয়া। ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেকথা মমতা জানেনা। যক্ষের ধনের মত আগলে আছে মমতা মনির মিয়ার সংসার। ওদের বিরহে মমতায় দুচোখ হতে কান্না ঝরে ঝরে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে। মনির মিয়া আর মুনু মিয়ার অপেক্ষায় কাটছে সারাবেলা। মনির মিয়া আর মুনু মিয়া যে আর ফিরে আসবেনা ওরা যে, না ফেরার দেশে চলে গেছে এটা মমতাকে বলা উচিৎ হবেনা। তার অপেক্ষার সময়গুলো মৃত্যুর আগে শেষ হবে কিনা কে জানে? কে মমতাকে বলবে যে মনির মিয়া আর মুনু মিয়া আর কোনদিন ফিরে আসবেনা? এই কঠিন কথাটা তাকে না বলাই ভালো। সব জেনে শুনেও এই কঠিন সত্য কথাটা ফজল মিয়া মমতাকে বলেনি কোনদিন বলবেও না। কেউ জানেনা কবে শেষ হবে মমতার অপেক্ষার দিনগুলি।