একদেশে এক মানুষ ছিল

আপডেট: এপ্রিল ৫, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

মাহী ফ্লোরা

রূপুর সারা শরীরে ব্যথা। পাশ ফিরতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। দু দিন হল জন্ম নেয়া একটা শিশু তার পাশে শুয়ে। নার্স একবার দেখে গেছে। কর্কশ কণ্ঠে বলে গেছে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করো নাইলে বুকে দুধ আসবেনা। রূপু জানে শালদুধ শিশুর জন্য ভাল। মনে হচ্ছে সেটুকুও শরীরে নাই। বাচ্চারে তুলে বুকের কাছে নেয়ার সামর্থ্য রূপুর নাই। সরকারি হাসপাতালে ওয়ার্ডের মেঝেতে এক কোনে রূপু আর তার ছোট্ট শিশুটা শুয়ে আছে। শ্বাস নিচ্ছে, ট্যা ট্যা করে কেঁদে জানান দিচ্ছে সে এসেছে। পৃথিবীতে এসেছে।

অথচ কোথাও কোনো মমতার স্পর্শ যেন নেই এই পৃথিবীতে। যে কোনো জন্মেরই উৎসব থাকে। অথচ সে উৎসবের দেখা সবাই পায়না। রূপুর পাশে তার মায়ের থাকার কথা ছিল। তার শ্বাশুড়ির থাকার কথা ছিল। বিভিন্ন ননদ দেবর ভাবিকূলের ফলমূল হরলিক্স নিয়ে পাশে এসে সেবা করার কথা ছিলো। তারা নেই। তারা কেউ পাশে নেই। কেন নেই সেসব ভাবতে রূপুর ভাল লাগেনা। সে মোমেন আলিকে ভাবে। যে মোমেন আলির অর্থ নেই বিত্ত নেই, বুকে আগলে রাখার মত শক্ত চওড়া বুক নেই, অথচ ভালোবাসার মত তীব্র এক শক্তি আছে। এই এক শক্তির জন্যই মোমেন আলি ধর্ম ছেড়ে পরিবার ছেড়ে নিজের বাপের দেয়া নাম ছেড়ে নিজের সমস্ত নিয়ে রূপুর হয়ে গেছে।

চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকায় রূপু। সব শিশুর পাশে মায়ের সাথেও কেউ না কেউ আছে। কেউ কলা ছিলে মাকে খাইয়ে দিচ্ছে। কেউ শিশুকে ধরছে বুকের কাছে। রূপুর গায়ে এক ফোটা শক্তি নেই আড়াইকেজি ওজনের শিশুটিকে বুকের উপর তুলে মুখে খাবার তুলে দেয়।
সিজারের কষ্ট, অপুষ্টির কষ্ট, মানসিক দুর্বলতার সমস্ত সুযোগ নিয়ে রূপুকে এই জীবন দুর্বল থেকে আরো দূর্বল করে তুলেছে। পাশে পড়ে আছে সকালের দেয়া পাউরুটি, কলা, সেদ্ধ ডিম।

রূপুর চোখ ফেটে কান্না আসে। কেউ আসুক। বুকের উপর শিশুটিকে তুলে দিক। স্যালাইন লাগানো হাতটা দিয়েই সে তার বুকের মানিককে বুকে ধরে রাখবে। কেউ আসুক। মোমেন আলি কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে। আহারে লোকটার খাওয়ার ঠিক নাই। যত্নের ঠিক নাই। নিশ্চয় সকাল থেকে কিছু খায়নাই। একবার আসলে তো পাউরুটি কলাটাই মোমেন আলি খেতে পারতো। মোমেন আলি হন্যে হয়ে ঘুরছে। পরিচিত বিভিন্ন দ্বারে হাত পাতছে। সরকারি হস্পিটাল বলে সামান্য খরচে সিজার সম্ভব হয়েছে। সিজারের পুরো টাকাটা সে তার সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে মিটিয়ে দিতে পেরেছে।

কিন্তু ওষুধ? এত দামি দামি ওষুধ, আরো আনুষঙ্গিক খরচ আরো টাকা আরো টাকা কোথায় পাবে মোমেন আলি? বংশ পরম্পরায় মুচির কাজটাই শিখেছিলো। যখন সে মোমিন আলি হয়ে ওঠেনি, রূপুকে ভালোবাসার আগে তার সামান্য মুচির কাজেই তো দিব্যি চলে যেত।

একটা ছাপড়া ঘরের পাশেই তার জুতা পালিশের ছোট আখড়া। এই ঘরটায় রূপু এসে উঠবে। তার সাত রাজার ধন ভালোবাসার পুত্র এসে উঠবে। অথচ এক কোনা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। একটা পলিথিন দিয়ে ঘেরা জরুরি। একটা ছোট্ট মশারী। একটা দুধ খাওয়ার ফিডার।

সামনে বাড়িটায় ২তলা উঠছে। ওদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে মোমেন আলি ভাবে খালাম্মা দিল দরিয়া মানুষ। চাইলে কি আর ফেরাবে? কিছুতো দিবেই। কতবার কত কিছু করে দিয়েছে মোমেন। গাছের ডাব পেড়ে দিয়েছে। ইঁটের গাড়ি নরম মাটিতে ঢুকে গেছিল, সে তার সমস্ত শক্তি দিয়েতো গাড়িটা গর্ত থেকে উঠিয়েছে।

-বাচ্চা পালতে পারবানা তো বাচ্চা নিসো কেন? খাওয়ানোর সামর্থ্য নাই বিয়া করাইতো অন্যায় হইসে। দেখতেসোইতো বাড়ির কাজ চলতেসে। ১০০ টাকা ধরো। যাও। বিরক্ত কইরোনা।

মোমেন আলির মাথা নিচু থেকে আরো নিচু হয়ে যায়। লজ্জায়। অপমানে। মনে হতে থাকে আসলেইতো! পৃথিবীতে ভালবাসা খুবই অদরকারী জিনিস। কি দরকার ছিল বুকের মানিক নিয়া স্বপ্ন দেখার। লজ্জা করে খুব লজ্জা করে মোমেন আলির। আট দশজন হিজড়া ঢোকে।

-কি মা জননী বাড়ি তুলতেসেন। আমাদের তো ভুললে বাড়ির ইঁটে চিহ্ন রাইখা যামু।
পেছনের দুজন তালি মারতে থাকে। আরেকজন বুকের কাপড় খুইলা দাঁড়ায়। পেট দেখায়া বলে বুক হইয়া পেটে যে খাদ্য যাইবো মা জননী টাকা না দিলে কেমনে!
[
কিছুক্ষণ ১ হাজার ২ হাজার ৩ হাজার নানা রকম তর্ক বিতর্ক শেষে মা জননী ৪ হাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে হিজড়া বিদায় করে।
মোমেন আলির ঠোঁটের কোনায় থুথু জমা হয়। গিলতে গিলতে ভাবে শালার হিজড়া হইলেই তো ভাল করতাম!