অশরীরী

আপডেট: মার্চ ১৫, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

অশরীরী

সালাম হাসেমী:সুদূর দুবাইয়ে জিসান রড মিস্ত্রীর কাজ করে। পাঁচ বছর কাজ শেষে আজ দেশে ফিরে আসছে। বিমান বন্দরে নেমে তার মনে মানুষ দোলাকে সারপ্রাইজ দেবে, এ ভাবনা থেকে সে প্রিয় মানুষকে কোনো ফোন করেনি কিংবা আগাম কোনো সংবাদ দেয়নি। একটা মাইক্রো গাড়ি ভাড়া করে সে তাতে উঠে বসল,বাড়ি আসার জন্য। চাকাওয়ালা দুটো লাগেজ ভর্তি করে জিনিসপত্র এনেছে। বড় লাগেজটা তার নিজের বাড়ির লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের জন্য এবং ছোট লাগেজটা ভর্তি জিনিসপত্র তার মনের মানুষ দোলার জন্য। গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে ঢাকার মহাসড়ক দিয়ে। এ পাঁচ বছরে ঢাকা শহর অনেক উন্নত হয়েছে, মেট্রোরেল আর উড়াল সেতুর গতি জীবনকে একটা আলাদা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। সে গাড়ির জানালা খুলে এ চিত্র দেখে এক্কবারে মুগ্ধ। তখন বসন্তকাল।

অশরীরী চৈতী মাসের চপল হাওয়া গাড়ির জানালা দিয়ে যখন ভিতরে ঢুকছে তখন মনপ্রাণ ভরে উঠছে এক অভূতপূর্ব শীতলতায়। এ বাতাসে জিসানের দেহ-প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনের সুখে সে তার মোবাইলে গান শুনছে। গানের তালে তালে তার দেহ নাচ্ছে। মনে আর ফুর্তি ধরে না। কেবলই ভাবছে কখন সে বাড়ি পৌছবে। বাড়ি যাওয়ার আগে সে তার প্রিয়তমা দোলার সাথে দেখা করবে। বারবার দোলার সুন্দর মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। এজন্য তার গাড়ি দোলাদের বাড়ির সামনে হয়ে যাবে। গাড়ি ঢাকার শহর পেরিয়ে দূরে ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লে সে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগল।

দেখতে দেখতে ্এক সময় তার গাড়ি পদ্মা সেতুর পার হওয়ার জন্য টোল সেন্টারে এসে থেমে। টোল দিয়ে গাড়ি সামনের দিকে যেতে লাগল্। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি পদ্মা সেতুর ওপর উঠল। জানালা দিয়ে সে পদ্মা সেতু দেখতে লাগল। দুবাইয়ে থাকতে সে টিভিতে পদ্মাসেতুর ছবি দেখেছে। টিভিতে পদ্মাসেতুর ছবি দেখে সে মনে মনে অনেক দিন ভেবেছে কবে দেশে ফিরে যাবে আর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দেখবে। তাই সে মনোযোগ দিয়ে পদ্মা সেতু দেখছে। দেখতে দেখতে তার গাড়ি পদ্মাসেতু অতিক্রম করল। সেতু দেখা শেষ হলে আবার সে দোলার কথা ভাবতে লাগল।

এভাবে অনেক ক্ষণ দোলাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার গাড়ি নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে পৌঁছলো। খুশিতে তখন তার মনটা ভরে গেল। কারণ সে এখন প্রায় বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তার গাড়ি ফরিদপুর শহর পার হয়ে গ্রামের রাস্তা ধরল। তখন রাতদুপুর। সে গাড়ির জানালা দিয়ে রাতের আঁধারে তার গ্রামের দৃশ্য দেখতে লাগল্। কিন্তু রাতের অশরীরী আঁধারে তেমন ভালো করে গ্রাম দেখা যাচ্ছে না। অনেক দিন পর গ্রামের দৃশ্য তার কাছে খুব ভালোই লাগছে। কতদিন সে তার গ্রাম দেখে না।

এবার সে গুনগুন করে গ্ইাতে লাগল শাহানাজ রহমতউল্লাহ গান ‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয় / যেথায় কোকিল ডাকে কুহু , দোয়েল ডাকে মুহু মুহু।’ গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার গাড়ি এবার দোলাদের বাড়ির সামনে যখন এলো তখন ঠিক রাতদুপুর বেলা। জিসান ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললে ড্রাইভার গাড়ি থামালে, সে দোলাকে ফোন করে। দোলা এসে জিসানের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির গ্লাসের ভিতর দিয়ে জিসানকে দেখে বলল, আসবা আগে জানাওনি ক্যান ? জিসান গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, সারপ্রাইজ বুঝলে সারপ্রাইজ। তাই বলিনি।

অশরীরী বলতে বলতে জিসান দোলাকে অনেকক্ষণ দুচোখ ভরে দেখল। তারপর ছোট্ট লাগেজটি তার হাতে দিয়ে বলল,‘দেখো তোমার জন্য যা যা এনেছি ত তোমার পছন্দ হয় কিনা ?’ দোলা জিসানের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চাকাওয়ালা লেগেজটি টেনে বাড়ির দিকে যায়। বাড়ির বেকি বেড়া পাড় হবে ঠিক সেই সময় জিসানের গ্রামের আবু মোড়ল এসে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল , – জিসান, বিদেশ থেকে এসে বাড়ি না গিয়ে দোলার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছো কেন? প্রাণের সখা তো এ জগতে নেই। দোলা তো গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে পরোপারে যাত্রা করেছে। ও তো আর আসবে না। দুঃখ করো না। বাড়ি যাও।

কি মোড়ল চাচা আাপনি কি আমার সাথে তামাশা করছেন নাকি ? দোলা তো কেবল মাত্র আমার হাত হতে জিনিস পত্রের লাগেজ নিয়ে চলে গেল। ওই যে দোলা লেগেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, লেগেজের চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওই যে বেকি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তার ওড়নার আঁচলের দেখা যাচ্ছে। আর আপনি বলছেন দোলা পরোপারে চলে গেছে। থাক আর তামাশা করতে হবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখা গেল রাস্তার ডান পাশের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কে যেন জিসান ও আবু মোড়লের দিকে এগিয়ে আসছে। আসতে আসতে যখন একেবারে কাছে এলো তখন পরিস্কার করে দেখা গেল। আবু মোড়ল তো দোলাকে দেখে ভয়ে বরফের মত জমে গেল। সে মনে মনে ভাবল দোলা তো গলায় দড়ি দিয়ে মারা গিয়েছে, সে এখানে আসল কি করে ! ভয়ে কোন কথা বলতে পারল না।

অশরীরী নির্বাক নয়নে দোলার দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুলা আবু মোড়লের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে বড় বড় চোখ করে অনেক ক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার ডান হতে এক টুকরা রশি। সে আবু মোড়লের দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলল, -এই আবু মোড়ল আমাকে হত্যা করতে সহায়তা করেছে। তুমি যখন দুবাই গেলে তখন এই আবু মোড়লের কু-নজর আমার দিকে। সে আমাকে পথে ঘাটে একা পাইলে কু-প্রস্তাব দিতে লাগল। আমার বাবাকে বলল তার সাথে আমাকে বিয়ে দিতে। মোড়লের দুইডা বউ থাকা সত্ত্বে সে আমাকে বিয়ে করার জন্য নানান তাল বাহানা করতে লাগল। আমি বিয়েতে রাজি ন্ই বলে সে আমার বাবাকে সমাজে এক ঘরে করে রাখবে। আমার বাবাকে তার মস্তান দিয়ে মারপিট করার ও খুন-জখমের ভয়-ভীতি দেখাতে লাগল।

একদিন বাবাকে মারপিট করে নদীর ঘাটে আধা মরা করে ফেলে রাখল। তখন বাবা মোড়লের ভয়ে আমাকে তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হল। মোড়লের লোকজন আমার কাছে যে মোবাইল ফোন ছিল তা কেড়ে নিলো আর সবাইকে বলে দিল যে আমার কাছে কল দিবে তাকে শেষ করে দেওয়া হবে। অশরীরী সে কারণে আমি তোমাকে কল করিনি। বিয়ে ঠিক হল। বিয়ের আগের দিন আমার গায়ে হলুদ হল। ওই রাতে আমি ভাবলাম যে মোড়লের সাথে বিয়ে হওয়ার চেয়ে মরণ ভালো। তাই আািম গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছি। এই নারী লোভী ক্ষমতাধর আবু মোড়ল আমার বাঁচার অধিকার কেড়ে নিয়েছে আমি ওকে আর এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে দিবো না। এ কথা বলে দোলা তার হাতের রশি নিয়ে এগিয়ে গেল আবু মোড়লের দিকে।

আবু মোড়লের গলায় রশি পেচিয়ে দুহাত দিয়ে দিল টান, অশরীরী আবু মোড়ল চোখ দুটো বড় বড় করে দম বন্ধ হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে গেল। জিসান মৃতু আবু মোড়লের দিকে তাকিয়ে আছে এমন মুহূর্তে দোলার দিকে তাকালে তাকে আর দেখা গেল না। অনেক খোঁজাখোঁজির পর দেখা গেল দোলা রাস্তার ঢাল দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছে। কেমন যেন অশরীরী..