তাজরিহ

আপডেট: মার্চ ২৯, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

আরিফুল হাসান

আজ আবার তাকে দেখলাম। সেই আগুনরঙা দুপুরে বরাবরের মতোই আমি তার দিকে চোখ রাখতে পারলাম না। একপলক চোখে পড়লো মাত্র। আজ তাকে বেশ অচেনা লাগছিলোÑ যেনো দূর গ্রহের বাসিন্দা কোনো। তাকে দেখে না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু সবদিকেই সে আমার বিরাজমান। তাকে না দেখে থাকতে পারি? আমি ভাতের প্লেটে মুখ লুকিয়ে ফেলি। যতটা সম্ভব মাথা নিচু করা যায়, করে ফেলি। লুকিয়ে ফেলতে চাইছি নিজেকে। যেনো ভালোবাসা কোনো অপরাধ। আমি যেনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোই আমার কাজ। যে প্রেমে পড়েছিলাম, তাতে আমি আর পড়তে চাই না। থাকতে চাই না সে প্রেমের আলয়ে। পুড়তে চাই না তার ভালোবাসায়। কিন্তু সে আমাকে পোড়াবেইÑ যেনো এই তার পণ।

আমি তার মান ভাঙার চেষ্টা করবো কেনো? দেখি বিষণ্ন তাকে। সে আমাকে দেখে অবাক হয় কি না জানি না। আমি তাকে দেখে অবাক হই। একটি মানুষ কী পরিমাণ অন্বেষী হলে খুঁজে বের করতে পারে আমার মতো অধরাকে? এটি তার পক্ষেই সম্ভব। তাই অফিস আমার যত দেরিতেই বাড়তে থাকে। খাবার সময় আমার যতই ঘুরে যাক, সে আমাকে দেখে নেবেই। যেনো আমি তার বর, নিজ হাতে খাচ্ছি কিনা দেখে নিচ্ছে। এমন মায়াবী পরিবেশে, যখন সে এসে পাশে দাঁড়ায়, ঠিক পাশে না, ছায়ার দূরত্বেরও অধিক, দূরেই বলা যায়। কিন্তু আমরা দুজনে জানি, সে আমার ঘারের উপর চোখ দুটো সেঁটে দিয়ে দেখে নিচ্ছে আমার প্লেটে ক’লোকমা ভাত। আমি ভাত নিচ্ছি কি না তাও দেখে নিচ্ছে। ক’বার ডাল নিচ্ছি, খাবার সময় পানি খাচ্ছি কি না বেশি, এসব সে দেখবেই। তবে তাকে দেখলেই আমার পিপাসা বাড়ে বেশি। আজ অফিসের প্রাঙ্গনে সিগারেট ফুঁকছি, দেখি, সে যায়। তার যাওয়ার ছন্দ দেখলে আমি বুঝি।

সে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। না, তার চলার ছন্দ চিনি আমি। তাও না। তার দেহের সুবাস, না না না, সুবাস না, আলো। তার দেহ থেকে এক ধরনের আভা বেরোয়। আমি সে আলোক চিনি। কোমল একটা আলো। সে যখন যায়, চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ছুটে যাচ্ছে গাড়ি, অফিস পাড়ায় ছুটি মানেই ছুটি। একদম কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। আমার অফিসের অর্ধেক টাইম হলো। কারণ, আজও দেরিতে এসেছি। ক্রিয়েটিভের এই একটা সুবিধে, সময়টা পুষিয়ে দিলেই হয়। তবে এ অবস্থা বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। এমনিতেই আমার রেপুটেশন খারাপ। কী জানি চোখের চশমা ফেলে ভুলে কখন যে উন্মাদ ছুটে যায় চাকরি, সে খবর কে রাখে?

তো, যাচ্ছে তো সে যাক না। আমার চোখে কেনো পড়তে হবে। সেও না দেখার ভান করে দেখে নিলো আমাকে। আমার চেয়ে ফাস্ট। এতই দ্রুত যে আমি যখন তার ছায় দেখলাম তখনই তার অভিব্যক্তি এমন যে, মনে হবে সে কখনো দেখেনি আমাকে, কোনোদিনও না। তবু আমরা এই অচেনা শহরে একবুকে আশা বেঁধে জীবনমান অতিক্রম করি। অতিক্রমনের পথে আমাদের পথ আগলে দাঁড়ায় কাটা, দাঁড়ায় আগুন। আগুনের উত্তাপ ভুলতে আমরা নাগরিক শহরে সিগারেট খাই। কষে টান দিলাম একটা। তার ছায়াপথে ধোঁয়া ছাড়তে ‘সুন্দলী ললনা, হেইলা চলে দুইলা চলে’ টিজ করলাম মনে।

মনে সে থেকে গেলো। প্রতিটা সিগারেটের টানে, তাকে আমি পুড়লাম, আমি তারমধ্যে পুড়লাম। মনে আগুন নেয়া হয়ে গেলে আমরা কি ফিরে যাবো শীতের দেশে? তাজরি কোথায় যাবে? তার বাসাটা জেনে নেয়া গেলে তার পিছু নেয়া যেতো। কিন্তু তার বাসায় তো আমি যাবো না। ভুলে থাকবো, তাকে ভুলে থাকবো একেবারেই। দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালালাম। সে চলে গেছে অনেক্ষণ হয়। নাগরিক শহরে জ্যাম, আমি তার চলার পথে চোখ রেখে সিগারেটে টান দিই। না, তাকে পাই না। কে কারিশমা অন্য কোনো আলো।

সিগারেটের টানে মজা পাই না। পায়ের তলায় পিষে ফেলি আধখানা সিগারেট। লিফটের এগারো তলায় উঠে আমাদের বিস্তৃত অফিসে ছড়িয়ে পড়ি। সে বোধহয় এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে। তার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি কতদূর?

যত দূরত্বই হোক, আমরা কি ভাংতে পারি না। তুমি বলবে জানি, ‘না’। তোমার এই ছোট্ট ‘না’ টি শোনার অপেক্ষা করিনি আমি। তার আগেই তোমাকে না করে দিয়েছিÑ হ্যাঁ, প্রথম প্রথম প্রেমে আমিই পড়েছিলাম। তোমার রূপে চোখ রাখা সে দায় হতো, তবু দেখার চেষ্টা করতাম। তৃষ্ণা নিয়ে খুঁজতাম তোমাকে। তুমি আমার রাতের নিশি কেনো হলে? কেনো এই রাত দুপুরেও তুমি আমার ছায়া হয়ে আছো? মস্তিষ্কজুড়ে কেনো, কেনো এতো ভাবাচ্ছো

আমায়? নিষ্ক্রান্তি দাও, তোমার এ প্রেম থেকে মুক্তি দাও আমায়, আমি তোমাকে ভালোবাসি সত্য, কিন্তু আমি তোমার সাথে প্রেম করি না। তুমি মানলে না। এই মধ্যরাতেও আমাকে ডুবালে। আমি তোমার চলে যাওয়ার ছন্দ ধরে লিখে রাখলাম এই রাতের গল্প, এই অন্ধকারের পরিভাষা। রাতের চাঁদটা ক্ষীণ হয়ে কোথাও ভেঙে পড়ছে। আমি সে চাঁদে দেখলাম তোমার মুখ। মুখটা বড় বেজার, চোখে জল। আমি কি সে অশ্রু সইতে পারবো? তুমি কাঁদো, এ আমি চাইনি। তোমাকে যেন কখনো কাঁদতে না হয় এ জন্য দূরে আছি। কিন্তু তুমি তা মানতে পারলে না।

অফিসের অন্য কলিগকে নিয়ে আমাকে জেরা করলে। তোমার প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর আমি কী কী প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম? সে-কি? তুমি এতো কাঁদছো কেনো? এ তো শ্রাবণ মাসের ঢল! উঠো, ফুল ফুটছে বাগানে, দেখো, এখন শেষরাত, বসন্তকাল। তোমার এলোচুল পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়ে। তোমার মুখটা নেমে গেছে হাঁটুর কাছাকাছি। এই মধ্যরাত, তুমি চাঁদ ভেঙে কাঁদছো, সে-কি আমার জন্য? আমার জন্য যদি কাঁদো, তবে কাঁদতে দাও দুচোখকে তোমার। তারা কাঁদুক। ওই অপলক উজ্জ্বল চোখে তো চোখ রাখতে পারিনি কখনো, এখন এই বৃষ্টিস্নাত চোখে, তোমার রূপের ম্লান আভা দেখি। দেখি তোমার ভেতরের দহন। কতোটা পুড়ে পুড়ে তুমি খাক হচ্ছো। অন্ধকারের ভেতর গল্পটা অনুমান করে এগোয়। হয়তো এরকম সে ভাবতে পারে আজ রাতে।

যে ভাবনার শেষ নেই, সে ভাবনাই সামনে এসে দাড়াবেÑএমনই আজিব। তাজরির বাড়ি হয়তো এখন নিবিড় ঘুমে। সেও ঘুমোচ্ছে অঘোরে। তার স্বপ্নের ভেতর হয়তো আমি ঢুকে গেছি এতক্ষণে। এতক্ষণে স্পন্দনের ভেতর, দেহের ভেতর হয়তো জড়িয়ে গিয়েছে নিবিড় নম্র ঘুম। সে ঘুমের খোঁপায় তাজরি অন্য আলোর বৃন্দ ছড়াতে ছড়াতে শুয়ে থাকবে। তার ঘুমের ভেতর, তার দেহজ অন্ধকারের ভেতর হয়তো আমার স্বপ্ন পৌঁছাবেই না। এমনিই মুখোশে ফাগুনে, ভীরু ভীরু কাঁপা অক্ষরে আমি গল্প লিখে যাবো।
আসলে কি আমি তার রূপকে ভয় পাই? এমন অবাক সুন্দরি পথেঘাটে দেখি তো, কিন্তু অফিসে দেখি না। সে যখন অফিসে আসে, আটশো বিয়াল্লিশটা লাইট যেনো ম্লান হয়ে আসে। আমি তার উজ্জ্বল নক্ষত্র-লোচন দেখেছি, কী কৌতুক ও চোখে! যেনো খুশির ফোয়ারা ঝিলিক দিয়ে উঠে। ‘প্রেমে পড়লেই মন ভালো হয়ে যায়’ এরকম একটা অবস্থা। একপলক দেখেই অনুমান করে নিয়েছিলাম, ও বনপলাসের সেই সখ্যতা, যা প্রেম নয়, কাম নয়, আরও দুর্দম জয় ধারণ করে। ও চোখে আমি ডুবেছিলাম সত্য, কিন্তু এখন ও-চোখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করো তাজরিহ, তোমার নামের জিকিরের ওসিলায় মাফ করো আমার প্রেম ও প্রত্যাখ্যান।