মিথ্যা

আপডেট: এপ্রিল ২৬, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

হানিফ ওয়াহিদ:


আমার তখন বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সবকিছু ফাইনাল, শুধু কবুল বলাটুকুই বাকি। পাত্রির বাড়ি আমাদের খুব কাছেই। বলতে হয় আমাদের প্রতিবেশী। দুই পরিবারে এক্কবারে গলায় গলায় ভাব হয়ে গেছে। ওই বাড়ির ভালো ভালো রান্না করা খাবার প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ি আসছে। শুটকিমাছের ভর্তা আলু-ডালনা, আলুভর্তা বানালেও হবু জামাই হিসেবে তার ভাগটা আমি একটু বেশিই পাই।

মিথ্যা মনে মনে ফন্দি আঁটছি, কীভাবে বিয়েটা আঁটকে রেখে এরকম খাবার আরও বেশিদিন খাওয়া যায়, বিয়েটা কিভাবে দেরি করা যায়। একবার বিয়ে হয়ে গেলে তো আর এমন মজার খাবার নাও পাঠাতে পারে। এই সময়ই আমার খাালাতো বোন বিপাশা ও একদিন আমাদের বাড়ি এসে হাজির। বিপাশা বেশ ছটফটে টাইপ মেয়ে, আমাকে ভীষণ পছন্দ করে। আড়ালে আবডালে অনেক সময়ই ও আমাকে জানু বলে ডাকে। আমার মাও ওকে বেশ পছন্দ করে। নিজের মেয়ের মত ভালোও বাসে।

বিপাশা সুন্দরী রূপবতী হলেও কারণে অকারণে ও একটু বেশিই দুষ্টুমি করে। নানান রকম মিথ্যা কথা ও ইনিয়েবিনিয়ে বলে মায়ের কাছে ও আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়, যা আমার মোটেও পছন্দ হয় না। বলতে গেলে সহ্যই হয় না। আর এ কারনেই আমি ওকে আপন করে নিতে মোটেও রাজি নই। ও তো একটা হাইস্পিড ট্রেন।
সে বসতে বসতে বলল, -শুনলাম, তুই নাকি বিয়ে করতে যাচ্ছিস। তা আমাকে তোর অপছন্দ হওয়ার কারণটা কী, জানতে পারি?
আমি মুখে কিছুটা বিরক্তির ভাব নিলাম, তুই কথায় কথায় আমার সাথে মিথ্যা কথা বলিস এটা আমার পছন্দ না।

-আরে ও তো আমি এম্নিই তোর সাথে দুষ্টুমি করে বলি।
এবার আমি জ্ঞানী মানুষের মত ভাব নিয়ে বললাম, -শোন বিপাশা, এই যে তুই দুষ্টুমি করে হলেও মিথ্যা কথা বলিস, বলার র্চ্চা রেখেছিস, এটাও আমার পছন্দ না। দুষ্টুমি করে বলতে বলতেই লোকজন একসময় সত্যিকার মিথ্যাবাদী হয়ে যায়। যারা মিথ্যাবাদী, তারা হচ্ছে শয়তানের বন্ধু। সবসময় সত্যি কথা বলবি, বুঝছিস? ভুলেও কখনো কারও সাথে মিথ্যা কথা বলবি না। ঠিক আছে? বিপাশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, -ঠিক আছে। মেরে ভাই, ঠিক আছে। -এই তো লক্ষী মেয়ে। চাইলেই মিথ্যা কথা বলা ছাড়া যায়। শোন, যারা মিথ্যা কথা বলে তারা সংসার জীবনে কখনোই সুখি হতে পারে না। এই আমাকে দেখ, আমাকে কখনো দেখেছিস মিথ্যা বলতে? দুনিয়া উল্টে গেলেও আমার কাছে কখনো মিথ্যা কথা পাবি না। নেভার এভার!

মা ট্রেতে তেলেভাজা পিঠা নিয়ে এলেন। এই পিঠা আমি বেশ পছন্দ করি। পিঠা দিয়ে ফিরে যেতে যেতে বললেন, এই বিপাশা, রাতে কিন্তু তুই খেয়ে যাবি। তোর জন্য রান্না বসাইছি। বিপাশা পিঠা খেতে খেতে বলল, তোর হবু বউ দেখতে কেমন রে ? আমার চেয়েও কি ও বেশি সুন্দরী? তার রান্নার হাত আমার চেয়েও কি বেশি ভালো?

নতুন বউয়ের প্রশংসা করতে হয় শুনেছি এটাই নিয়ম। তাই ওম ওঠা পিঠা মুখে নিয়ে ওম ওম করে খেতে খেতে বললাম, অবশ্যই সুন্দরী। আর তার হাতের রান্না তো অসাধারণ। দেখছিস না, আমি হবু জামাই, আমি পছন্দ করি বলে তেলের পিঠা বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বল তো, পিঠার স্বাদ কেমন হয়েছে? আমার কাছে তো এর স্বাদ অসাধারণ লাগছে…
বিপাশা আরেক কামড় পিঠা মুখে নিয়ে বলল, এই-এই এই পিঠা তোর বউ বানিয়েছে?

হ্যাঁ। কেন, আমার কথা বিশ্বাস হয় না? আমাকে কখনো মিথ্যা কথা বলতে শুনেছিস? আমি মরে গেলেও কারও সাথে মিথ্যা কথা বলি না এবং না জেনে কথা বলি না।
বিপাশা রহস্যময় গলায় বলল, আমি তো শুনলাম তোর বউ রাঁধতেই জানে না।

এবার আমি রেগে গিয়ে বললাম, এই তোদের এক সমস্যা, কোনো বিষয়ে ভালো করে না জেনেই চট করে অগ্রিম একটা কথা বলে দিস। এটা খুবই খারাপ অভ্যাস। না জেনে কখনোই কথা বলা ঠিক না।
সে হাত মুছতে মুছতে বলল, পিঠার স্বাদ অসাধারণ হয়েছে। সত্যি, তোর বউয়ের রান্নার হাত বেশ ভালো। শুভ কামনা রইল। বলেই সে উঠে চলে গেল।
আমি তখনো পিঠা খেয়ে চলেছি। কিছুক্ষণ পর মা আমার রুমে ঢুকে বললেন, বিপাশা কই?
আমি বললাম, চলে গেছে। আহা, এতো ভালো একটা মেয়ে! ওকে না খেয়ে যেতে বললাম?

আমি বড় করে পিঠায় আরেকটা কামড় দিয়ে ওম ওম করে খেতে খেতে বললাম, আরে কীসের ভালো মেয়ে? এক নাম্বার মিথ্যাবাদী মেয়ে, খালি অগ্রিম কথা বলে। যারা অগ্রিম কথা বলে তাদেরকে আমি পছন্দ করি না। পিঠা পাইলা কই মা? নিশ্চয় ঐ বাড়ি থেকে পিঠা আসছে?

আরে না! তুই পছন্দ করিস বলে বিপাশা নিজ হাতে পিঠা বানিয়ে এনেছে। আমি তো খেলাম, বেশ মজা হয়েছে। অরিজিনাল খেজুর গুড় দিয়ে তৈরি। মেয়েটার রান্নার হাত বেশ চমৎকার। পিঠা আমার গলায় আঁটকে গেল, কোনোরকমে বলতে পারলাম, পিঠা কে বানিয়েছে?

কেন, বিপাশা! কিন্তু তুই এতে অবাক হচ্ছিস কেন? আমি আর কথা বলতে পারলাম না, পিঠা মুখে নিয়ে সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম!