জীবন যখন যেমন

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সিরাজুল ইসলাম মুন্টু
ওসমান ব্যাপারি সকালে উকিলের চেম্বারে, সাথে আছে দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারি মতি মিয়া। তার আজ দুটো মামলার দিন আছে। একটা ছেলের আর একটা তার মেয়ের। ছেলের রেপ কেস। শিউলী নামের মেয়েটা অপহরণ ও ধর্ষণ দুটো মামলাই দিয়েছে। তিনজন মিলে মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে আর ধরা পড়েছে ওসমান ব্যাপারীর ছেলে মনির। আর মেয়ে মালা তার কলেজের এক নেশাগ্রস্থ সিজারকে বিয়ে করেছে বাড়ি থেকে পাঁচলক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে। মনিরের মামলায় মনিরের যেন সাজা না হয় সে আশায় অনেক বড় বড় উকিল দাঁড় করাবে কোর্টে। আর মালা যেন আবার ঘরে ফিরে আসে সে আশা নিয়ে ওসমান ব্যাপারী আজ কোর্টে এসেছে।

ওসমানের জীবনে আজ চরম পরীক্ষা। ছেলে মেয়ে স্বামী স্ত্রী এই চার জনের সুখের সংসার তার। বড় ও একমাত্র ছেলে, মনির। সে গত কয়েক বছর আগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার হল থেকে বহিস্কার হবার পর থেকে সেই যে, বখাটেদের দলে ভিড়ে গেল। ব্যাপারী অনেক চেষ্টা করেও ফিরাতে পারেনি, তাছাড়া মনির একমাত্র ছেলে হওয়ায় তার মা জামিলা একটু বেশিই লাই দিতো। ওসমান কিছু বললে জামিলা মনিরের পক্ষ্য নিয়ে সবকিছু হালকা করে দিতো। এতে করে মনির আরও বেশি লাই পেয়ে একেবারে মাথায় উঠে গেছে। আর মাথা থেকে হাজার চেষ্টা করেও নামানো সম্ভব হয়নি।

ছেলে-মেয়েদের বেশি আদর সোহাগ করলে তারা যে মানুষ হয়না সেকথা ওসমান ব্যাপারী হাড়ে হাড়ে বুঝে
গেছে। কিন্তু বুঝে তো কোন লাভ নেই। কারণ সমাধান করার কিছু নাই তাই যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হবে।
ওসমানের পিতৃহৃদয় তাইতো সবকিছু জেনেশুনেও আশায় বুক বেধে আছে। যে, তার ছেলে মুক্তি পাবে,

অপরাধী যদি তার সাজা সম্পর্কে আগে থেকে জানতো তাহলে সে কখনোই অপরাধ করতনা। মনিরের উঠতি বয়স ভালো লেগে যায় শিউলী নামের এক মেয়েকে। মনির ভেবেছিল শিউলী তার প্রস্তাব সহজে মেনে নেবে।
মনিরের কথা মেনে নিয়ে মনিরের লালসার বলি হবে। কিন্তু না শিউলী তা মেনে নেয়নি। মনির তাকে অনেক রকমের প্রলোভন দিয়েছে। শিউলী ঝালমুড়ি ওয়ালার মেয়ে হলেও সে টাকার লোভে কিংবা ভালোবাসার অভিনয়ে ভুলেনি। আত্মসম্মান বিকিয়ে সে নিজেকে বিলিয়ে দেয়নি। অনৈককিছু প্রলোভন দিয়েও যখন শিউলীকে বশে আনতে পারেনি মনির তখন সে হিস্র পশুর আকার ধারণ করে।
এমনিতেই মনির সন্ত্রাসী চাঁদাবাজী ছিনতাই এর সাথে জড়িত। সে শহরের নষ্ট মানুষদের সাথে মিশে

একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন আগে শিউলী যখন স্কুল থেকে ফিরছিল তখন মনির তার কয়েকজন পাণ্ডা নিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। শিউলীর বাবা থানায় খবর দিলে পুলিশ শিউলীকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। শিউলী হাসপাতালে মারা যায়। পুলিশ ওই স্থান থেকে মনিরের মানিব্যাগ ও ছবি উদ্ধার করে। পরে আদালতে পাঠালে, আদালত তাকে জেল-হাজতে পাঠায় ।

আজ মনিরের মামলার রায় ঘোষণা হবার কথা। ওসমান ব্যাপারী চায় তার সয়-সম্পত্তির বিনিময়ে হলেও তার ছেলে যেন সাজা না হয়। তিনি শিউলীর বাবা রহমত ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছে যান। কয়েক লক্ষ্য টাকারও প্রস্তাব দেন। রহমত রাজি হয়নি। তার কথা, আমি কার জন্য টাকা নেব। আমার সংসারে ওই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। পাঁচ বছরের মা মরা মেয়েকে নিয়ে আমি শহরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম গ্রামে যত সব অশিক্ষিত মূর্খ গরীব মানুষ বাস করে। শহরে যেমন বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি আছে তেমনি আছে মানুষের মনে সভ্যতার আলো শিক্ষার আলো। শহরে বাস করে আলোকিত মানুষ। যেখানে মানুষের জানমাল মান সম্মান সব নিরাপদ থাকবে। আমি গ্রাম থেকে আসি গরীব মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছি। ঝালমুড়ি বেচে যা আয় হয় তা দিয়ে বাপ মেয়ে খেয়ে পরে মেয়েটাকে মানুষ করব সে আশায় দিনরাত পরিশ্রম করি। আমার রাজ প্রাসাদ দরকার ছিলনা। আমি কিছুই চাইনা ভাই। আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেন। আমি গ্রামের মানুষ গ্রামে চলে যাব। আর কোনদিন আপনাদের শহরে আসবনা। টাকা নয় আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দেন।

ওই মেয়েটা ছিল আমার জীবনে আশার তরী, সেই তরীটাই যখন ডুবে গেল, বলতে পারবেন ওসমান ব্যাপারী আমি কি নিয়ে বাঁচব। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করিনি। আমার একমাত্র অবলম্বন কেন কেড়ে নিলেন ওসমান সাহেব? আমার মেয়ের চেয়ে সুন্দরি মেয়ে কি এই শহরে ছিলনা। তবে কেন আপনার ছেলে আমার মেয়ের এমন সর্বনাশ করে

আমাকে অকূলে ভাসাল। ওসমান সাহেব আপনি চলে যান, হাজার কোটি টাকা দিলেও আমি মামলা তুলে নেব না। আমি কার জন্য টাকা নিবো। আমি টাকা নিলে শিউলীর আত্মা আমাকে ক্ষমা করবে না। শিউলীর মায়ের আত্মাও আমাকে ক্ষমা করবেনা। আমি চাই অপরাধীর উচিত শাস্তি হোক, আমাকে অকারণে টাকার লোভ দেখাবেন না ব্যাপারী সাহেব। টাকা আপনাদের মত মানুষের জীবনের সব হতে পারে। তাছাড়া আপনার মেয়ে যদি হতো শিউলী হতো তাহলে আপনে কি করতেন, বলেন ? আমার শিউলীর মৃত্যুর বিচার দেখে আর যেন কোন বখাটে আর কোন শিউলীর উপর অত্যাচার করার সাহস না পায়, অপরাধীর শাস্তি হোক এটা আমি মনে প্রাণে চাই।

ওসমান ব্যাপারী রহমতের কথাশুনে খুব লজ্জা পেল। সত্যিইতো শহরে আসা গ্রামের মানুষগুলোকে শহরের মানুষগুলো যদি নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে ওরা আর কোথায় যাবে। ওসমান ব্যাপারীও মনের সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেছিল যে, মনিরের যাই হোক সে কোন উকিল ধরবে না। কিন্তু ওসমানের স্ত্রী জামিলার কান্না দেখে সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। বদলে গেছে। মনিরের মামলা কোর্টে উঠল। সাক্ষী প্রমাণে মনির দোষি সাব্যস্ত হওয়ায় আদালত তাকে যাবত জীবন কারাদণ্ড দিলো। ওসমান ব্যাপারী দু’চোখের জল মুছতে মুছতে কোর্ট থেকে বের হয়ে আবার উকিলের চেম্বারে এলো। এবার মালার মামলা কোর্টে উঠবে। ওসমান ব্যাপারী সিজারের নামে নারী অপহরণের মামলা দায়ের করেছে। ওসমানের

একমাত্র মেয়ে মালা কলেজে পড়ে। একই কলেজের ছাত্র সিজারকে সে ভালোবাসে। সিজার নেশাখোর বলে বাবা মা তাকে দেখতে পারেনা। ওসমান এবং মালার মা জামিলা অনেক নিষেধ করেছে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু মালা কোন কথা শুনেনি।

বান্ধবীর বিয়েতে যাচ্ছে বলে। কাপড়-চোপড় সহ পাঁচলক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে সিজারকে বিয়ে করেছে। এই বিয়েটাকে মেনে নিতে পারবেনা বলেই ওসমান ব্যাপারী মামলা করেছে। আদালতে দাঁড়িয়ে মালা ওসমানকে উদ্দেশ্য করে বলল, উনি আমার বাবা নন। তাছাড়া সিজার আমাকে অপহরণ করেনি। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। আমার বিয়ের প্রয়োজন তাই বিয়ে করেছি। উনি

যদি আমার বাবা হতেন
তাহলে আমার পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে দিতেন। ঘর সংসার করব আমি আমার যাকে ভালো লাগবে আমি তাকেই বিয়ে করব উনার তাতে আপত্তি থাকার কথা কেন থাকবে?
মতি ওসমান ব্যাপারীকে ধরে একরকম জোর করে বাসায় নিয়ে এলো কিছুক্ষণ সবাইকে সান্ত¦না দিয়ে মতি

নিজের বাসায় চলে গেল। রাতে জামিলা বলল, মনিরের বাবা তুমি আমার মনিরের জন্য কিছুই করতে পারলে না। না গো মনিরের মা আমি কিছুই করতে পারলাম না। তোমার ছেলেটার যাবৎ জীবন দণ্ড হলো। মানে মনিরের যাবত জীবন জেল আর মালা যদি আমাদের পছন্দ মত কিংবা স্বাভাবিক ভাবে বিয়ে করত তাহলে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে নাইওর আসতে পারত। যেহেতু সে নিজের মত বিয়ে করেছে তাই আজীবন আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেনা। মালার ও যাবৎ জীবন খোলা জেল হয়ে গেছে।

মনিরের বাবা আমি কি নিয়ে বাঁচব। যা নিয়ে বাঁচবে শিউলীর বাবা রহমত, জামিলা একদিন তুমি আর
আমি একা ছিলাম। কত তদবির তাগাদা দরগায় সিন্নি মানত করে ছেলে মেয়ে পেলাম। আমাদের যত আদর যত্ন সব উজাড় করে দিলাম, কিন্তু তবু ওদের মন পেলাম না, আমাদের ভালোবাসা ওদের মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। ওরা আমাদের মান সম্মান আদর ভালোবাসা সব পায়ে ঠেলে যে যার মত সুখের সন্ধানে চলে গেল। আমরা আগের যে দু’জন ছিলাম এখন সে দু’জন। এখন বলো কার জন্য কি করলাম। জামিলা আমাদের জীবন এমন কেন হলো। মনিরের বাবা, জামিলা জীবন যখন যেমন, তখন তাকে মেনে নিতে হয়। তুমি কাঁদছ কেন জামিলা, যাদের ছেলে মেয়ে নাই তারা কি বেঁচে থাকছেনা। আমরাও তাই ভেবে নেব। জামিলা চোখ মুছো। চলো ছাদে যাই, অনেক দিন পূর্ণিমার চাঁদ দেখিনি চলো পূর্ণিমার চাঁদটাকে দেখে দুঃখ ভুলার চেষ্টা করি। চলো। দু’জনে ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কি যে বলল, আমি শুনতে পাইনি হয়ত ওসমান ব্যাপারী জামিলা আর তাদের অন্তরযামী জানে।