‘আজ নওগাঁ স্বাধীন হবে ,নয়তো নওগাঁর মাটিতে তোমাদের কবর হবে’

আপডেট: ডিসেম্বর ১১, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

মো. আবুল কালাম আজাদ

মো. জাফর আলী প্রাং, পিতা- খোদাবক্স প্রাং, মাতা- আজিরণ বেগম, গ্রাম- চলনালী, ইউনিয়ন- ধারবারিষা, উপজেলা- গুরুদাসপুর, জেলা- নাটোর। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে জাফর আলী প্রাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি নং-০১৬৯০০০০৫১২।

১৯৩৪ সালে জন্ম হিসেবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালিন তাঁর বয়স ছিল ৩৭ বছর, টগবগে যুবক। স্ত্রী ও এক বছরের এক ছেলে সন্তান ও মা-বাবাকে ঘরে রেখে দেশমাতৃকার টানে স্বাধীনতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন। প্রথমে লাল্পুরের ওয়ালিয়ার ময়নার যুদ্ধে পরে হান্ডিয়াল নওগাঁর পলাশডাঙ্গার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। জাফর আলী নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। আসুন , আমরা তাঁর নিজ মুখ থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরত গাঁথার গল্প শুনি-
১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর গুরুদাসপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন। তিনি নৌকা প্রতিকে ভোট চাইলেন।

তখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বক্তৃতায় বলেছিলেন- ‘ভায়েরা আমার, আমাকে নৌকা প্রতিকে ভোট দিবেন। আমি জয়যুক্ত হতে পারলে কৃষক ভাইদের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফ করে দিব। আর তোমাদের নামে সার্টিফিকেট মামলা হবে না। গরিব-দুখিদের বাসস্থান করে দেব, জেলে ভাইদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দেব, তাদের জমি দেব, তাঁতি ভাইদের জন্য তাঁত করে দেব। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৬০ টি কাপড়ের মিল রয়েছে। পুর্ব পাকিস্তানে একটিও নাই। আমি কাপড়ের মিল করে দেব। যাতে আমার শ্রমিক ভায়েরা খেটে খাতে পারেন। তিনি আরো বলেছিলেন, ৪ আনা সের চিনি খাওয়াবো।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে আমি ভাতে মরতে দি । বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে আমরা আপ্লুত হয় পড়লাম। বঙ্গবন্ধুর নৌকা প্রতিকে ভোট দেওয়ার জন্য আমরা দুই হাত তুলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। সেসময় গ্রামে ফিরে ১০ পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে আওয়ামী লীগের সদস্য হলাম। গ্রামে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করলাম। সে সময় চলনালী গ্রামের ঈমান উদ্দিন সরকার, উত্তর নারিবাড়ি গ্রামের হাসান উকিল, সন্তোষপুর গ্রামের গুলমামুদ, পোয়ালশুড়া গ্রামের গুলমামুদ মহুরি, শিধুলী গ্রামের রিয়াজ শাহ্ চাঁন চেয়ারম্যান, ধারাবারিষার নজির মন্ডল, তালবাড়িয়ার আলিমদ্দিন চেয়ারম্যান, চাঁচকৈরের হাকিম সরকার, এন্তাজ মোল্লা, কায়েম বিশ্বাসদের নিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হলো।

আমরা নৌকায় ভোট দিলাম। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খান গদি ছাড়ে নাই। তারপর থেকেই আমাদের সেই কমিটি একটি সংগ্রাম কমিটি পরিণত করেছিলাম আমরা। এরমধ্যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্যে পুরো প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম, নাটোরের লাল্পুর থানার ওয়ালিয়া নামক স্থানে পাকিস্তানি মিলিটারি আক্রমণ করেছে।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক তীর-ধনুক, লাঠি, ফালা, সড়কি, হাসুয়া যে যা পাড়ি তাই নিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে ওয়ালিয়াতে গেলাম। সেসময় ওই অভিযানে ছিলেন- ছইমদ্দিন, আব্দুল কাদের, বাচ্চু, সেকেন্দার (তার হাতে রাইফেল ছিল) সহ অনেকেই ছিলাম। ওয়ালিয়াতে গিয়ে দেখলাম ট্রাকের উপর ত্রিপল দিয়ে কয়েকজনের লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। আজাহার মাস্টারকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশটি ঝুলন্তই ছিল। ওয়ালিয়ায় তিনদিন থাকার পর ফিরে আসলাম। তখন চারিদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেবল গুরুদাসপুরে কোন যুদ্ধ নাই। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। এরই মধ্যে নওগাঁও মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের খোঁজ পেলাম। এরমধ্যে হঠাৎ করেই গুরুদাসপুরে ১৭ জনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করলো পাকবাহিনী।

যুদ্ধে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গেল। ১ বছরের ছেলে আর স্ত্রীসহ বাবা-মা ছেড়ে আমি, আফসার , র্খবির ও রহমান নৌকা নিয়ে চলে গেলাম মির্জাপুর হাটে। সেখানে গিয়েই দেখা হলো বীর মক্তিযোদ্ধা এডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন, আনোয়ার হোসেন মাস্টার, সাত্তার চেয়ারম্যান, মকবুল হোসেন ও আনিসের সাথে। নৌকা নিয়ে তাদের সাথে চলে গেলাম নওগাঁর ক্যাম্পে। যাওয়ার পথে তোফাজ্জল ভাই এলাকার অনেক খোঁজ নিলেন আমার কাছ থেকে। সেখানে গিয়ে তোফাজ্জল ভাই বললেন-‘তোদের আর বারী ফেরা হবে না।

বাংলা স্বাধীন করে তারপর ফিরতে হবে। সে সময় নওগাঁ ক্যাম্প ছিল ৭ নং সেক্টরের আওতায়। লতিফ মির্জা ছিলেন ওই ক্যাম্পের সর্বাধিনায়ক। লতিফ মির্জা আমাকে নৌকা চালানো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্নার দায়িত্ব দিলেন। নওগাঁ ক্যাম্পে তিন দিন থাকার পর সর্বাধিনায়ক লতিফ মির্জার দেওয়া দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমার নৌকায় ২৫ জন যোদ্ধা নিয়ে চলে গেলাম হান্ডিয়াল। শুরু হল দেশ মাতাকে মুক্ত করার লড়াই। কখনো কুঁচিয়ামারা ক্যাম্প, কখনো তাড়াশ, কখনো হান্ডিয়াল নৌকা নিয়ে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকলাম।

১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর রাতে আমরা নওগাঁর পোরতাব নামের একটি হাটখোলাতে অবস্থান করছিলাম। খবর পেলাম, রাতেই নওগাঁর ক্যাম্পে ফিরতে হবে। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে সবাই জড়োসড় হয়ে যাচ্ছিলাম। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে তবুও নৌকা নিয়ে চলে গেলাম নওগাঁর ক্যাম্পে। ফজরের নামাজ পড়ে সবেমাত্র নৌকার ওপর বসলাম। হঠাৎ গুলির আওয়াজ ! সময় তখন ১১ নভেম্বর প্রভাত। গুলির আওয়াজের সাথে মানুষের আর্ত্মচিৎকার ভেসে আসছিল।এরই মধ্যে লতিফ মির্জা একটা হুইসেল দিয়ে যোদ্ধাদের ডাকলেন।

আমরাসহ মোট ৮০৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে জড়ো হলেন। লতিফ মির্জা বললেন, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে। তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। নওগাঁ স্বাধীনের জন্য তোমাদের লড়তে হবে। সবাই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নাও। ‘আজ নওগাঁ স্বাধীন হবে, নয়তো নওগাঁর মাটিতে তোমাদের কবর হবে ‘। লতিফ মির্জার নির্দেশে আমি নৌকা থেকে অস্ত্র নামিয়ে বাঙ্কারে ঢুকলাম। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধের সময় আমি বাঙ্কারে যোদ্ধাদের গোলা-বারুদ এগিয়ে দিচ্ছিলাম। সেই সকাল ৭ টায় যুদ্ধ শুরু হয়ে দুপুর ১ টায় শেষ হলো। যুদ্ধে ৪০ জন মিলিটারির মধ্যে ১ জন জীবিত ছিলেন। সেই পাক সেনাকে শিতলাই দিঘিতে মারা হলো। আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করলাম। নওগাঁ স্বধীন হলো।

এরপর লতিফ মির্জার নির্দেশে নওগাঁও ক্যাম্প ভেঙ্গে দেওয়া হলো। সবাই শিতলাই দিঘি এলাকায় তিন দিন থাকার পর লতিফ মির্জা বললেন, শত্রু পক্ষের সাথে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র আমাদের হাতে মজুদ নাই। তাই সব যোদ্ধাদের প্লাটুনে ভাগ হয়ে অন্যত্র যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন লতিফ মির্জা। তাঁর নির্দেশে সবাই প্লাটুনে ভাগ হয়ে গেল। আমিও অন্য ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথে দুর্ভাগ্যবশতঃ ধরা খেলাম। শাহজাহান রাজাকারসহ তার সঙ্গিরা আমাকে নিয়ে গেল লবিন নামে একটি বিলের মধ্যে। সেখানে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুদাসপুর থানায় আটকে রাখা হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিশ্চিতের জন্য আমার ওপর চালানো হলো অমানুষিক নির্যাতন। তবুও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেইনাই। আমি বলেছিলাম, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই নাই। মুক্তিযোদ্ধাদের চিনি না। রাজাকাররা ভেবেছিল, আমি সত্যিই কিছু জানি না। তাই, সে সময় জমি বিক্রির টাকা দিয়ে কোনমতে সেই যাত্রা মুক্তি পেলাম।

বাড়িতে ৪/৫ দিন অবস্থান করছিলাম। এই ৪/৫ দিনে থানার কর্মকর্তা মনমহন আবারও আমাকে ধরে থানায় নিয়ে নির্যাতন করলেন। সে যাত্রায়ও মুক্তি পেলাম। কিন্তু দেশ তো তখনো স্বাধীন হয়নি। বাড়িতে এক রাত থাকার পর আবারও যুদ্ধের জন্য বের হলাম। কিন্তু তোফাজ্জল ভাইদের কোন সন্ধান পাচ্ছিলাম না। গোপনে খুঁজতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে দেশ স্বাধীনের সুসংবাদ পেলাম। কিন্তু গুরুদাসপুর তখনো স্বাধীন হয়নি। হানাদার, রাজাকার বাহিনীর দখলেই ছিল। এরই মধ্যে শুনলাম মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসপুর থানা দখল নিবে। সাহস করে এগিয়ে এলাম। দেখলাম, মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল ভাই, আব্দুস সাত্তার, আনোয়ার হোসেন মাস্টার ফিরে এসেছেন। তাঁদের সাথে যুক্ত হয়ে থানা দখল করলাম। সেই দিনটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সাল।

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ভালই ছিলাম। কিন্তু ’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমরা আর নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা বলে পুলিশ বেশ কয়েকবার থানায় ধর নিয়ে নির্যাতন করেছে। এভাবেই চলছিল আপন ঘরে পরাধীনতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন। রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সমাবেশ করলেন। আমিও সেই সমাবেশে ছিলাম। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সমসবেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুনছিলাম।

বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বললেন-‘আপনারা কি আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের মুক্তিযোদ্ধা?’ আমি সবার সাথে হাত তুলে সারা দিলাম। শেখ হাসিনা বললেন- ‘দুই হাত তুলে কথা দেন,আপনারা আমার সাথে আছেন।’ আমরা দুই হাত তুলে আবারো সারা দিলাম। তার পর শেখ হাসিনাকে ভোট দিলাম। তিনি সরকার গঠন করলেন। আমাদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে শেখ হাসিনার সরকার গেজেটভূক্ত করলেন। তারপর আবার বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে শুরু করলাম। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনা।’
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট,গুরুদাসপুর, নাটোর ।