কঠোর সামরিক প্রহরায় ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন

আপডেট: মার্চ ১৫, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

সামরিক প্রহরায়
নিজস্ব প্রতিবেদক:১৫ মার্চ, ১৯৭১ : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রায় সকল জেনারেলকে নিয়ে কঠোর সামরিক প্রহরায় ঢাকা আগমন করেন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার জন্য। ‘খ’- অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খান তেজগাঁ বিমান বন্দরে তাঁকে সংবর্ধনা জানান। বিমান বন্দর থেকে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ভবনে উঠেন। কোনো সাংবাদিককে বিমান বন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। কোনো বাঙালি অফিসারও বিমান বন্দরে যাননি। এমনকি ইয়াহিয়ার সাথে আগত জেনারেলদের নামও প্রকাশ করা হয়নি। ঢাকা আসার আগে ইয়াহিয়া লারকানা গিয়েছিলেন। ঘোষণা করা হয়েছিল যে তিনি পাখি শিকারে গেছেন। বস্তুতঃ পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে, পাখি শিকারের নামে ইয়াহিয়া বাঙালি জাতির সকল আশা-আকাক্সক্ষা রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেয়ার জন্য ভুট্টোর সাথে গোপন শলা-পরামর্শ চূড়ান্ত করতে লারকানা গিয়েছিলেন।
ঢাকায় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা দীর্ঘায়িত করে আরো সৈন্য, আরো সমরাস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনার সুযোগ সৃষ্টি করেন ইয়াহিয়া।

পূর্ব ’পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃংখল আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সমস্ত সরকারি সংস্থাসহ সর্বস্তরের জনগণ এই সামরিক প্রহরায় গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশনামা প্রচার করেছি, সর্বশক্তি দিয়ে তা তারা অনুসরণ করছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার ও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে, তার জন্যও জনগণকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।”

ভূট্টো এদিন কোনো এক সময় করাচির নিশতার পার্ক দিয়ে যাবার সময় একদল পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছাত্র তার গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ জানায়। তারা আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বলে ভূট্টোর বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বিক্ষোভকারী ছাত্ররা বলেন যে, ‘আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।’

১১৫ নম্বর সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বায়তুল মোকাররম চত্বরে আয়োজিত জনসভায় নেতৃবৃন্দ বাংলা-দেশের স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য সর্বস্তরের বাঙালির প্রতি আহ্বান জানান।

পরিষদের অন্যতম নেতা আসম আব্দুর রব বলেন, “বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। তাই কোনো সামরিক বিধি আমাদের দেশে জারির ক্ষমতা পাকিস্তানি জান্তার নেই। বাংলার জনগণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই মেনে চলবে।” স্বাধীনতা রক্ষার জনযুদ্ধে গণবাহিনীর গঠনের জন্য তারা আহ্বান জানান।

শাহজাহান সিরাজ বলেছেন, “বাঙালি জাতি আজ স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে নেমে পড়েছে। আমাদের প্রতিপক্ষ বর্তমানে নিশ্চুপ আছে। তবে চরম আঘাত হানার জন্য তারা হয়ত অপেক্ষা করছে। তাদের প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবেনা।”

সভার সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, “ছয়দফা ও ১১ দফা দিয়ে জনসংহতির ফুটো কলসিতে আমরা সিমেন্ট লাগাতে চেয়েছিলাম। তারা আমাদের সে প্রচেষ্টাকেও সামরিক প্রহরায় ব্যর্থ করে দিয়েছে।”
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে বলেন, “কিছু সংখ্যক দৃষ্কৃতিকারী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পোশাক ও টুপি নকল করে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।” এদের ধরে আওয়ামী লীগ অফিসে সোপর্দ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানান।

বাঙালি হত্যাযজ্ঞের অন্যতম রূপকার পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কেন্দ্রের ক্ষমতা দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর কাছে এবং প্রদেশগুলোর ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আমরা চাই দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলো সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার অধিকারী হোক।”
পিডিপি প্রধান নূরুল আমিন ঢাকার প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ভূট্টোর দাবিকে অবান্তর ও নৈরাশ্যজনক বলে উল্লেখ করেন। একটি জাতীয় সংসদের দুটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগই একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল।”

জমিয়তে ওলামায়ে পকিস্তান, ন্যাপ (ওয়ালী), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, পিডিপি ও জামায়াতের কতিপয় নেতা করাচিতে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, “ভূট্টোর হুমকি ও উস্কানিতে ইতোমধ্যেই দেশে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভূট্টো একাই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।”

২৮ ফেব্রুয়ারি লাহোরের জনসভায় ভূট্টো বলেছিলেন, “যে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তার পথ অনুসরণ না করবে, তাদের হাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়া হবে।” এ থেকেই বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের শুরু।

স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, সিতারা-ই- খেদমত ও সিতারা-ই ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন। একইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনির চৌধুরী ‘তম খা-ই-কায়েদে আযম’ খেতাব বর্জন করেন।
পাকিস্তান কনভেনশন মুসিলম লীগ সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।