বঙ্গবন্ধু নতুন কর্মসূচিতে ৩৫ নির্দেশ

আপডেট: মার্চ ১৪, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:১৪ মার্চ, ১৯৭১: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৫ মার্চ থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। কর্মসূচিতে ৩৫টি নির্দেশ ঘোষিত হয়। এসব নির্দেশনাবলি কার্যকরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ঘোষিত সকল নির্দেশ, অব্যাহতি ও ব্যাখ্যাসমূহ বাতিল বলে বিবেচিত করা হবে। বাংলাদেশের দুটি ব্যাংকে সরকারকে দেয় কর জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ এবং সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পুনরায় স্বাভাবিক নিয়মে চালু করার নির্দেশ।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি খান আব্দুল ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। আলোচনা শেষে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের শেখ মুজিব বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এলে তিনি তার সাথে দেখা করতে প্রস্তুত আছেন।’ তিনি জনৈক সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেন, প্রেসিডেন্ট কি এখন ঢাকায় আছেন? সমস্যা সমাধানের সময় উৎরে যাচ্ছে বলে স্থানীয় সংবাদ পত্রসমূহে যে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে সে
সম্পর্কে মতামত জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করুন এবং পরিস্থিতি লক্ষ্য করুন, আমিতো আন্দোলনে রয়েছি।’

খান আব্দুল ওয়ালী খান এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এমন এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছি যাকে প্রেসিডেন্ট দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেছেন।’ তিনি বলেন, তাঁর দলই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষদে যোগ দিবো এবং যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও মীমাংসা করার এটিই হচ্ছে উপযুক্ত স্থান।’

এদিন বঙ্গবন্ধু মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ বড় দুঃখজনক যে, এমন পর্যায়েও কিছু অবিবেচক মানুষ সামরিক আইন বলে নির্দেশ জারি করে বেসরকারি কর্মচারীদের একাংশকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ এদেশের মানুষ সামরিক আইনের কাছে মাথা নত না করার দৃঢ়তায় এককাট্টা। আমি তাই সর্বশেষ নির্দেশ যাদের প্রতি জারি করা হয়েছে তাদের হুমকির কাছে মাথা নত না করার আবেদন জানাই। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের পিছনে রয়েছে। তাদের দমিত করার উদ্দেশ্যে এই যে চেষ্টা তা বাংলাদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখাবার অন্যান্য সাম্প্রতিক চেষ্টার মত নস্যাৎ হতে বাধ্য।’

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভুত করতে পারবে না। কারণ প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণ-বরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মানুষ হিসাবে স্বাধীনভাবে তার আত্মমর্যাদার সাথে বসবাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। গত দু’সপ্তাহের মত হরতাল অব্যাহত থাকবে। আমি জনগণকে যে কোন ত্যাগের ও সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে যে কোনো শক্তির মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানায়।”

অপর এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, “জনগণের আন্দোলনের যে গৌরবোজ্জ্বল দ্বিতীয় সপ্তাহ সমাপ্ত করেছে তা অব্যাহত থাকবে। গত দু’সপ্তাহের মত হরতাল অব্যাহত থাকবে। সেক্রেটারিয়েট, সমস্ত সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।”

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি চেকপোস্ট বসান হয়, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার না হয় বা সামরিক বাহিনীকে কোনো রসদ সরবরাহ করা না হয়।

দেশরক্ষা খাতের বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারীরা ১১৫ নম্বর সামরিক আইন আদেশের বিরোধিতা করে এক মিছিল বের করেন। তারা যে কোনো মূল্যে অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ দপ্তর থেকে প্রচারিত এক নির্দেশে বলা হয়, রেলওয়ে চালু থাকবে। তবে রেলওয়ে চালু রাখার জন্য যে যে সেকশন খোলা থাকা দরকার, শুধুমাত্র সেগুলোই খোলা থাকবে। তবে সৈন্য চলাচল ও তাদের রসদ আনা-নেয়ার কাজে রেলকে ব্যবহার করা যাবে না। ঢাকা থেকে পান যেতে না পারার কারণে করাচিতে এদিন প্রতিসের পানের দাম ১৫০ টাকায় উঠে। ৪০ কোটি টাকার সূতিবস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় আসতো। কিন্তু তাদের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের উৎপাদন শতকরা ৬০ ভাগ কমে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের মিল মালিকরা এই প্রেক্ষিতে সরকারের কাছে দেয়া এক স্মারকলিপিতে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান।

এদিন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান জেড.এ ভূট্টো করাচির এক জনসভায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন। তার দল সুখি ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার এবং জনগণের কল্যাণের জন্যই জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর কামনা করেন।

ভুট্টো স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তার দল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষেরা এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে নিস্পত্তি হয়া সম্ভব। তিনি বলেন, দেশের দুটি সংখ্যাগুরু দল জাতীয় স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ সেটাই কামনা করেন। আওয়ামী লীগ প্রধানের সাথে আলোচনা করার জন্য তিনি এখনো পূর্ব পাকিস্তান যেতে রাজি আছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচির তিন দফা গ্রহণ করেছেন-বাকি তিনটি দফার বেলাতেও আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছান সম্ভব, একথা তিনি বহুবার বলেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টির জন্য কারো সাথে তার দলের চক্রান্তে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ভুট্টো অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, স্বার্থবাদী মহল নির্বাচনে জনগণের বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এদিন এক ঘোষণায় পাকিস্তানি খেতাব হিলাল-ই-ইমতিয়াজ বর্জন করেন।