বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে মিছিলের স্রোত

আপডেট: মার্চ ২২, ২০২৪, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:২২ মার্চ, ১৯৭১ : এদিন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকার প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ নামে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। এতে অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ, অধ্যাপক সোবহান ও কামারুজ্জামানের লেখা নিবদ্ধ ছাপা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু মুজিব লিখিত বাণীতে বলেন, ‘সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বন্দুক, বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবে না, কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত’।

এদিন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে মিছিলের পর মিছিল উপচে পড়ছিল। এর আগে একদিনে এত মিছিল আর আসেনি। মিছিলকারীদের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু মুজিবকেও এতবার বক্তব্য রাখতে হয়নি। অসংখ্যের মধ্যে একটি শোভাযাত্রার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৩ বছর বাঙালি শুধু মার খেয়েছে, আর আমরা মার খেতে রাজি নই। আর কোনো পঙ্গপালকে আমরা সোনার সম্পদ নষ্ট করতে দেব না। সে পঙ্গপাল বিনাশের জন্যই আমার জন্ম’।

এদিনে স্বাধীনতা আন্দোলনের অবস্থা সম্পর্কে একটি দৈনিকের ভাষ্য : ‘(আজ) সোমবার ছিল শপথে শপথে প্রদীপ্ত দিন। প্রহরগুলো শুধু নয়, প্রতি পথ যেন সংগ্রামের দুর্জয় প্রত্যয়ের একেকটি মৃত্যুঞ্জয় পতাকা হয়ে ৩২ নম্বর সড়কে আন্দোলিত করেছে। এত প্রাণাবেগ, এত উত্তাপ একবারে এতবার এসে সঞ্চারিত হয়নি। জনতার এ জোয়ার এর আগে আছড়ে পড়েনি-একদিনে এতবার ৩২ নম্বর সড়কে।’

প্রেসিডেন্ট-ইয়াহিয়া খান আগামী ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট-কালের জন্য স্থগিত করেন।
এদিন ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়া বৈঠক চলাকালে প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে প্রেসিডেন্টের ওই ঘোষণা প্রকাশ করেন। ঘোষণায় বলা হয়েছিল : ‘দেশের উভয় অংশের নেতাদের সাথে পরামর্শ করে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের সুবিধার জন্য প্রেসিডেন্ট আগামী ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট অল্প দিনের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন তাও বলা হয়। তবে জাতীয় পরিষদের পরবর্তী বৈঠক করে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হল।’

এদিন বঙ্গবন্ধু মুজিবের সাথে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার সাথে প্রেসিডেন্টের যে আলোচনা হয়েছে, তা তিনি ভূট্টোকে জানিয়েছেন এবং ভূট্টোর সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন। আলাপ-আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদি কোনো অগ্রগতি না হত, তাহলে আমি কেন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি? সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আজ প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা হবার কথা ছিল। তার সাথে আমি দেখা করতে গিয়ে দেখি যে, জনাব ভুট্টোও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন।’

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি অনেক আগেই দাবি করেছি যে, আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা পরিষদের অধিবেশনে বসবো না। এর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট পরিষদের স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেন, ‘ইতোমধ্যে বাংলাদেশে গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

এদিন বেলা প্রায় সোয়া ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর কড়া প্রহরার মধ্যে জনাব ভুট্টো তার হোটেল থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। এর প্রায় ৫ মিনিট পর বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর নির্ধারিত বৈঠকে যোগদানের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে উপস্থিত হন।

প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে উপস্থিত জনতা ভুট্টোর প্রতি বিদ্রƒপ ধ্বনী দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান। পরে তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে ভুট্টো বিরোধী তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। ভুট্টো বেলা সোয়া ১টার আর্টিলারির জনৈক লে. কর্নেলের পরিচালনায় সেনাবাহিনীর প্রহরায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে আসেন। ইউনিফর্মধারী সেনাবাহিনী ছাড়াও সাদা পোশাক স্টেনগানধারী তিন ব্যক্তি তার প্রহরায় ছিল। এদিনও হোটেলের কর্মচারীরা বাংলাদেশের নতুন পতাকা এবং কালো ব্যাজ লাগিয়ে হোটেলে কাজ করেন।