নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ভূট্টো ঢাকা আসলেন

আপডেট: মার্চ ২১, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:২১ মার্চ, ১৯৭১ : এদিন সন্ধ্যায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ভূট্টো কথিত রাজনৈতিক আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। ইয়াহিয়া অধির আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লারকানায় শিকারের নামে গিয়ে ইয়াহিয়া ভূট্টোর সাথে যে ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছিলেন তা আজ বাস্তবে রূপদান করতে উভয়ে দু’ঘণ্টা আলোচনা করেন।

আলোচনা শেষে পাকিস্তান ফিরে ভূট্টো পাকিস্তান প্রেস কাউন্সিলের মাত্র একজন প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎদান করেন। তিনি তখনও বাঙালিদের অপ্রস্তুত রাখার জন্য স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করে যান। তিনি বলেন, ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আপনার কাছে এখন শুধু এটুকু বলতে পারি।’

জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে তার ১২ জন উপদেষ্টা ও হিংস্র চেহারার অর্ধ ডজন বেসামরিক দেহরক্ষী ঢাকায় আসেন। দেহরক্ষীদের হাতে ছিল নিষিদ্ধ এসএমজি। পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে না পারার জন্য তিনি নাকি বেসামরিক এসএমজি সজ্জিত দেহরক্ষী সাথে আনেন। তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে তিনি আসেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। সে এক রাজকীয় সামরিক দৃশ্য। সৈন্যবাহিনীর তিনটি ওয়্যারলেস সজ্জিত জিপ ও একটি ট্রাক তার দলবলের গাড়ি পাহারা দিয়ে বিমানবন্দর থেকে হোটেলে নিয়ে আসে। সৈন্যদের সংখ্যা ৬০-এর ওপরে হবে।

এর মধ্যে ১৮৬ জন কমান্ডো ছিল। তাদের উর্দির ফিতা থেকে এ অনুমান করা হয়েছে। সৈন্যদের কাছে ভারি মেশিনগানসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। হোটেলের পুরো ৯ তলা সরকার তাদের জন্য রিজার্ভ করেন। ভূট্টোর সাথে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক অপেক্ষমান ছিলেন। তিনি কারো সাথে আলাপ করতে অস্বীকৃতি জানান।

এদিনেও পূর্বের অন্যান্য দিনের মত হোটেলের ফ্লাগপোস্টে পাকিস্তানি পতাকার বদলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। হোটেলের প্রতিটি কর্মচারীর বুকে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। বাইরে ছিল হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ বাঙালি। তারা বিভিন্ন ধ্বনী দেয় এবং প্লাকার্ড বহন করে। বিক্ষুব্ধ জনতা ভূট্টোর ঢাকা ত্যাগের দাবি জানায়। এ সময় ভূট্টোকে খুবই বিচলিত দেখাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে ভূট্টো তার দেহরক্ষী ও উপদেষ্টাদের নিয়ে ওপরে যাওয়ার জন্য লিফটে আরোহণ করেন। কিন্তু ভার বেশি হয়ে যাওয়ার জন্য লিফট ওপরে যাচ্ছিল না।

অন্তর্ঘাতমূলক কাজ মনে করে ভূট্টোর বেসামাল অবস্থা। এ অবস্থায় ভূট্টোর দেহরক্ষীরা লিফট থেকে নেমে পড়ে চারদিক এসএমজি তাক করে পজিশন নেয়। দেহরক্ষীরা নেমে পড়ায় লিফট ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। দেহরক্ষীরা দৌড়ে লিফটে উঠতে চেষ্টা করে কিন্তু লিফট ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। পরে পাশের লিফটে করে দেহরক্ষীরা ওপরে যায়।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদ ইয়াহিয়ার সাথে ৮০ মিনিটের এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের আগে সিন্ধুর বিশিষ্ট আইনজীবী আল্লাবক্স, খোদাবক্স-বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বাসভবনে দেখা করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এভাবে ১৬ মার্চ থেকে দিনের পর দিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের চেষ্টা করছিলেন-পূর্ব বাংলার দিকে তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারীদের সশস্ত্র হামলায় অসহযোগ আন্দোলনকারীদের রক্ত ঝরছিল। আর ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে ধাক্কা দিয়ে জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মির্জা প্রভৃতিদের নিয়ে প্রত্যেকটি ক্যান্টনমেন্টে সামরিক আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিলেন।

প্রতিদিন ৬ থেকে ১৭টি পিআইএ ফ্লাইট, বোয়িং ৭০৭ যোগে সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে এলাকায় আসছিল-আর ঢাকা থেকে সামরিক বাহিনীর পরিবারবর্গ ও অবাঙালি ধনিদের পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছিল। করাচি থেকে জাহাজযোগেও চট্টগ্রাম সৈন্য সামন্ত, ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আসছিল। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতা এদিন এক যুক্ত বিবৃতিতে ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’- এ সমগ্র বাংলাদেশে প্রতিরোধ দিবস পালনের আহ্বান জানান। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল, সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনে কালো পতাকার সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও সকাল ৯টায় পল্টন ময়দানে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ।