বাঙালিরা বাঁচবে, নয় মরণপণ সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে : বঙ্গবন্ধু

আপডেট: মার্চ ২৪, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:২৪ মার্চ, ১৯৭১ : এদিন যশোরে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর হেড কোয়ার্টারে রাইফেলের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং পতাকার প্রতি অভিবাদন করার জন্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার বাঙালি শত শত ব্যারিকেড রচনা করেন। কিন্তু এই ব্যারিকেড গুলি করে পাকিস্তান আর্মিরা ভেঙে দেয়। মানুষের লাশে ভরে উঠে রাস্তা-ঘাট। বাঙালি সৈনিকরাও জনতার আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে সাধারণ অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধের কী দুর্জয় প্রাচীর গড়ে তুলেছিল তা আজ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুরে বিহারিদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৫ জন বাঙালি বুলেট বিদ্ধ হয়ে শহিদ হন।

বঙ্গবন্ধু লন্ডনের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক পিটার হেজেল থার্স্টের বক্তব্য অনুযায়ী ২৩ মার্চ ইয়াহিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ, জেনারেল টিক্কা, জেনারেল মিঠঠা, জেনারেল ওমর, জেনারেল ঈশা, জেনারেল আকবর, জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, জেনারেল রাও ফরমান আলী, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান রিজভী প্রমুখের সাথে আলোচনাক্রমে বাঙালি গণহত্যা নক্সা চূড়ান্ত হয়ে যায়। এই অভিযানের সাংকেতিক নামকরণ হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। জেনারেল আকবর হোটেল ইন্টারকনে কয়েকবার এসে ভূট্টোকে গোটা নীলনক্সা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং প্রাসঙ্গিক পরামর্শ গ্রহণ করেন।

২৫ মার্চ, ৭১-এর মধ্য রাতের কিছু পূর্ব থেকে এ অভিযান সর্বাত্মক নিষ্ঠুরতার সাথে পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে ইয়াহিয়া রাতে প্রেসিডেন্ট ভবনে ফিরে এসে স্কচ-হুইস্কির নেশায় বুঁদ হয়ে যান। একটি জাতির সত্তাকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত ২৩ মার্চ গ্রহণের পরদিন অর্থাৎ ২৪ মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও রাও ফরমান আলী দুটি হেলিকপ্টারে করে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে গমন করেন এবং ব্রিগেড কমান্ডারদের নীলনক্সা সম্পর্কে অবহিত ও নির্দেশ প্রদান করে বিকেলে ঢাকা ফিরে আসেন।

এদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর ঢাকায় পৌঁছুলে শত শত জঙ্গি মিছিলের স্রোত ধানমন্ডির দিকে ধাবিত হয়। মানববোধ কোনো ভাষায় মানুষের এই সংগ্রামী রূপের বর্ণনা দান দুঃসাধ্য। জনতা তথাকথিত আলোচনার সময় ক্ষেপণের বিরুদ্ধেও ধ্বনি উচ্চারণ করে।

বিকেলে একটি বিক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘আরো প্রচণ্ড শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার নির্দেশ প্রদানের জন্য আমি বেঁচে থাকবো কি-না জানি না। তবে দাস হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বাঙালিদের রক্ষার জন্য আন্দোলনকে আরো তীব্রতর করে তোল। যত ষড়যন্ত্রই হোক, বাঙালিদের দাবি নস্যাৎ করার কোনো শক্তিই নেই। শহিদদের রক্তের সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না’।
তিনি জনগণকে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখিন হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।

গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘হয় বাঙালিরা তাদের জন্মভূমিতে বেঁচে থাকবে, না হয় বাঁচার এই মরণপণ সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’
এদিন বিকেলে প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতাদের সাথে বৈঠকে যাওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু মুজিব ড. কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ নামকরণের প্রস্তাব দেয়ার নির্দেশ দেন। এ প্রস্তাব সরকারি দলের নিকট উত্থাপন করা হলে দৃঢ়তার সাথে আপত্তি জানায়। ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের অন্যতম বিচারপতি কর্নেলিয়াস কনফেডারেশনের জায়গায় ‘ইউনিয়ন’ শব্দ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা তাও প্রত্যাখ্যান করেন।

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, আগামীকাল ২৫ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নামের প্রস্তাবটিও চূড়ান্ত করা হবে। এ প্রেক্ষাপটে জেনারেল পীরজাদাকে মুজিব-ইয়াহিয়া ঘোষণা চূড়ান্ত এবং আগামীকাল উভয়ের বৈঠকের সময় নির্দিষ্ট করার তাগিদ দেন। পীরজাদা বলেন, ‘খসড়া ঘোষণাটি আমরা রাতে আরো পরীক্ষা করে দেখবো। আর মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠকের সময় আগামীকাল চূড়ান্ত করা যাবে।’